সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করলে রিলসের মধ্যে অনেক ধরনের দর্শনীয় স্থান কিংবা নির্মল সবুজ ট্রাভেল ডেস্টিনেশন পাওয়া যায়, আমার অনেক বন্ধু ভ্রমণ আর ভজনরসিক। কেউ খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত কেউ কোথায় ঘুরে বেড়ানো যায় সেটা খোঁজায় ব্যস্ত। তাদেরই বানানো রিলস আমার ইন্সটা বা ফেসবুকে চলে আসে। এই রিলসের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নজরকাড়ে আমার। হঠাৎ আমার এক বন্ধুর রিলসে চোখ আটকে যায় আর আমি রাতের বাসে রওনা দেই, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আসাম ও ত্রিপুরাঘেঁষা এক জনপদ ‘বোবারথলে’। প্রাকৃতিক সব রূপলাবণ্য ও ঐতিহাসিক জীবনধারা নিয়ে এখনো লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় ‘বোবারথল’। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এটি একটি আদর্শ গন্তব্য। ঢাকা থেকে প্রায় ২৩০ কি.মি. দূরে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নে এর অবস্থান। বড়লেখা উপজেলা সদর থেকে বোবারথল গ্রামে যেতে হলে ৮ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। আর এ পথে পেরোতে হবে ১২টি সুউচ্চ টিলা। যার প্রত্যেকটির উচ্চতা সমতল ভূমি থেকে ৩শ’-৪শ’ ফুট ।
সুউচ্চ পাহাড়ি ট্রেইল, অগণিত প্রাকৃতিক ঝর্ণা, বিশাল লেক, গিরিখাত, বৈচিত্র্যময় আদিবাসী সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক স্থানীয় জীবনধারা নিয়ে বোবারথলে যাত্রাটা কিছুটা সরল ও কিছুটা রোমাঞ্চকর তবে পুরো জার্নিটা দারুণ উপভোগ্য। জহির কোনোভাবে মিস করতে চায়নি।
বোবারথল যাত্রায় আমার চমক শুরু হয় পাহাড় ও চা-বাগানের বুকচিরে ছুটে চলে ট্রেন জার্নি দিয়ে। ঢাকা থেকে এসে নামি কুলাউড়া জংশনে। তারপর অটোতে পৌঁছায় বড়লেখা উপজেলা সদরে, লোকাল বাসও চলাচল করে। তারপর মাত্র ১০ মিনিটে অটো করে পৌঁছে গেলাম বোবারথলের প্রবেশদ্বার ছোটলেখা বাজারে। তারপর শুরু চাদের গাড়ি কিংবা জিপ গাড়িতে পাহাড়-টিলা আর চা বাগানের বুকচিরে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা, আমি চাদের গাড়িতে চড়লাম। ক্রমাগত পাহাড়ের চূড়া আর ঢালুপথ পাড়ি দিতে থাকি, যত সামনে আগাই ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শত মিটারে উপরে উঠি হারিয়ে যাই সবুজের আবৃত এক পাহাড়ি জনপদের গহীনে, আর কি জানি পেছনে টানে হয়তো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি।
প্রাকৃতিক এই লীলাভূমিতে প্রবেশ করার দুটি রাস্তা রয়েছে, কেউ যদি গগণটিলা (হরতকি টিলা) দিয়ে প্রবেশ করেন তবে এই এলাকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (পাথারিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অংশ) গগণটিলার বিশালতা উপভোগ করবেন। গগণটিলা থেকেই পতিত দুটি প্রাকৃতিক ঝর্ণায় আপনি গা ভিজিয়ে নিতে পারবেন। তার পাশেই রয়েছে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ছবির মতো সাজানো গ্রাম গান্ধাই পুঞ্জি। সমৃদ্ধ আদিবাসী জীবনযাপন, বিশেষভাবে পান ও সুপারির জুমচাষ কীভাবে তাদের অর্থনীতিকে মজবুত করেছে। জহির কিছুক্ষণ আশপাশে ঘুরে দেখলো তাদের জীবনযাত্রা। তারপর জহির জিপ গাড়িতে করে ছোটলেখা চা বাগানের ভেতর দিয়ে বোবারথল নয়াবাজার রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে।
আমি যখন যাত্রাপথের অর্ধেকটা সময় পার করি ছবির মতো সুন্দর মনে হয় চা-বাগান। উঁচু পাহাড় চড়তে শুরু করার আগেই আমি যখন দেখতে পাই ছোটলেখা লেকের এত স্বচ্ছ জলরাশি, দেখে মনে হয় নেমে সাঁতারকাটি। প্রায় দেড় কি.মি. বিস্তৃত এই পাহাড়ি লেকের পাড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার কিছুক্ষণ বসে ছিলাম, চারপাশের সুউচ্চ পাহাড়ে আবৃত শীতল আবহে গা ছিমছিম ভয়ংকর অনুভূতি পেয়েছিলাম। জানতে পারি তার পাশেই রয়েছে আরেকটি আদিবাসী পল্লি ‘আগার পুঞ্জি’। খাসিয়া ও গারোদের এই পুঞ্জিতে যে কেউ ঢুঁ মেরে দেখে আসতে পারে, দেখতে পারে তাদের বৈচির্ত্যময় জীবনধারা। এরপর সোজা পথে উঁচু উঁচু পাহাড় পাড়ি দিয়ে রক্ত শীতল করা এক জিপ জার্নি শেষ করে এসে পৌঁছালাম বোবারথলের মূল জনপদে। একটা হাট-বাজারের মতো এলাকা।
বোবারথলে পৌঁছে দেখলাম ছোট ছোট ৮টি গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি রহস্যঘেরা পাহাড়ি বাঙালি জনপদ, অনেকটা সেকেলে সভ্যতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। মনে হবে ৮০ দশকে চলে আসছি। স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্গানিক কৃষিপণ্য, ঐতিহ্যগত খাবার, বিভিন্ন অচেনা ফল আর গ্রামীণ আতিথেয়তার এক আবহমান বাংলার খাঁটি জীবনধারা। প্রতিটি পাহাড় ও টিলার বাঁকে ছোট ছোট বাড়ি এবং গৃহস্থালি আয়োজন। প্রায় প্রতিটি বাড়ি ঘিরে পান ও সুপারি চাষ। জাম্বুরা, লেবু, জামির বা জাড়া (বিশেষ জাতের বড় লেবু), কমলা, লটকনসহ বিভিন্ন পাহাড়ি ফলের গাছগাছালির দেখতে পেলাম প্রতিটি বাড়িতে। কৃষিতে সমৃদ্ধ এই জনপদের মানুষ স্থানীয় উৎপাদনে তাদের বেশিরভাগ চাহিদার যোগান দেয়। ইন্টারনেট মোবাইল সবই আছে তবে তারা তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এটাই অনেকটা অবাক করল।
বোবারথলে জহির আরও দেখলো পেকুছড়া ঝর্ণা, করইছড়া ঝর্ণা, পরিরঢর ঝর্ণা (মুরাগঞ্জ ছড়া), গগণটিলা ঝর্ণা, ষাটঘরি সীমান্ত ছড়াসহ ছোট বড় প্রায় ৮টি ঝর্ণা আছে সময় স্বল্পতার কারণে সব দেখা হয় নাই। এখানকার প্রতিটি পাহাড়ি ঝিরির উপরিভাগে গহীন পাহাড়ে একটি করে ঝর্ণা রয়েছে, যেগুলোর কোনো নাম ও স্বীকৃতি নেই। স্থানীয়দের কাছে এসব ঝর্ণা বিশুদ্ধ পানির উৎস ছাড়া বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। এ ছাড়া গান্ধাই কয়লাটিলা, হরতকি চুনাপাহাড়, সাততলা টিলা (প্রাকৃতিক ব্রিজ), ছোটলেখা লেক, গগণটিলা, ছোটলেখা চা বাগান, জিংগাআলা শাহবাজপুর চা বাগান, গান্ধাই পুঞ্জি, আগারপুঞ্জি, ডিমাই পুঞ্জি ও বাংলাদেশের একমাত্র মুসলিম খাসিয়া পল্লি ‘মাঝ গান্ধাই পুঞ্জি’।
কোনো কোনো টিলা আবার একেবারে খাড়া। টিলার চুড়ায় ওঠতে একটু বেখেয়াল হলে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। মাঝে-মধ্যে রয়েছে, ঘন ঝোপ। এর ওপর রয়েছে বিষধর সাপ, বন বিড়াল, পাহাড়ি কুকুর, ভল্লুক-উল্লকসহ নানা জাতের হিংস্র বন্যপ্রাণীর উৎপাত। এসব ঝক্কি-ঝামেলা নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বোবারথল গ্রামের বাসিন্দারা পারতপক্ষে শহরের দিকে যান না। বোবারথলকে পরখ করতে দুই দিন ছিলাম সেখানে।
আপনার মতামত লিখুন :