ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
ভবঘুরে

জহির নামা

মিনহাজুর রহমান নয়ন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ০২:৫৩ পিএম

জহির নামা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

একজন ভবঘুরে বড়লোক বাবার ছেলে। নাম জহির ফকির, পুরা নাম জহুরুল ইসলাম ফকির। ফকির তাদের বংশগত উপাধি, এই ফকির ভিক্ষা করে না অবশ্য। জহির ফকিরের দাদা মফিজ ফকির একটু ধার্মিক ছিলেন। অনেকে দোয়া চাইতে আসত। তিনি দোয়া করে দিতেন। কাকতালীয়ভাবে তার দোয়া কবুল হয়ে যেত। ধার্মিক পরিবারের ছেলে হলেও জহির ফকির পুরো উল্টা। খামখেয়ালিপনায় ভরা, উড়নচন্ডি। চারুকলার ছাত্র। সবাই যেখানে সামনে এগোয়। সে শুধু পেছনে ফিরে যেতে চায়। সে ঘুরে বেড়ায় পুরান ঢাকা, মিরপুরের অলি-গলি। কী খোঁজে; সে নিজেও জানে না। খুব উৎসুক স্বভাবের জহির, তার চোখে আপনাদের দেখাবো আমাদের শহরের জীবন, ইতিহাস, গল্প; অনেক না দেখা সাম্রাজ্য। যেখানে ধরা দেবে পুরোনো বাড়ি, রাস্তা, সাঁকো, আরও অনেক কিছুই। যা আমরা দেখেও দেখি না।

জহিরের চোখে কার্জন হল

দুপুরে মনে হলো একটু ঢাকা শহরের কোথায় ঘুরি আর কিছু না দেখা জিনিস জানার চেষ্টা করি। সঙ্গে বাইরে খাওয়া দাওয়াটাও হবে। রিকশা করে যেতে শুরু করলাম পুরান ঢাকার বিরিয়ানি খেতে। হঠাৎ কার্জন হলের সামনে এসে রিকশা ব্রেক দিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে মনে হলো, এই বিল্ডিংটার অনেক গল্প আছে। তাই নেমে গেলাম, দেখতে চাইলাম এর গল্প ও ইতিহাস।

তৎক্ষণাৎ গুগল করে জানতে পারি, এ ভবনটিতে সংযোজিত হয়েছে ইউরোপ ও মুঘল স্থাপত্য রীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণে আংশিকভাবে মুসলিম স্থাপত্যরীতি। ভবনের বাহিরে কালচে লাল রঙের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। হয়তো লালই ছিল। সময়ের আবর্তে কালো হয়ে গেছে। মুঘল স্থাপত্যবিদ্যা ও কাঠামোর সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এর খিলান ও গম্বুজগুলো। গম্বুজ দেখলে অনেকটা মুঘল সময়ের অন্য স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। কার্জন হলের মধ্য দিয়ে হেঁটে চললে মনে হবে যেন আমাদের টিভিতে দেখা টিপু সুলতান বা সিরাজ উদ্দৌলার সময়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। 
কার্জন হলে বসে থাকতে দেখে এক বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞাসা করলাম কার্জন হল সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা। তিনি বললেন, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে, ঢাকা কলেজের ক্লাস নেওয়া হতে থাকে কার্জন হলে। পরবর্তী সময়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে কার্জন হল অন্তর্ভুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের জন্য, যা আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। জানতে পারি, এটি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুষদের কিছু শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষার হল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্রিটিশ পিরিয়ডে ব্রিটিশরা শুধু শাসন করেনি। তাদের কাজের সুবিধার্থে ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল জর্জ নাথানিয়েল কার্জনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং তার নামানুসারেই ভবনের নামকরণ হয়। বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার পর প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য রমনা এলাকার যেসব ইমারতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় কার্জন হল তার মধ্যে অন্যতম।’ গুগলে দেখলাম ইতিহাসবিদ দানী লিখেছেন, ‘কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল টাউন হল হিসেবে। কিন্তু ইতিহাসবিদ শরীফউদ্দীন আহমদ এক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন এ ধারণাটি ভুল। এটি নির্মিত হয় ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে এবং নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেন গাজীপুরের ভাওয়ালের রাজকুমার।’

আমি যখন কার্জন হলের সামনে দাঁড়ালাম। মনে হলো সুবিশাল বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে তার ইতিহাস বলে যাচ্ছে। আমি একটু হেঁটে চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। একজন বলল, ‘স্পেশাল কার্জন চা পান করিবার নিমিত্ত আপনার নিকট আসিয়াছি?’ আমার কাছে তাকে বেশ মজার মানুষ মনে হলো। কার্জন চা। এটি প্রথম শুনলাম। কৌতূহলবশত তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কী জানতে পারি, আপনি কি করেন?’ ভদ্রলোক সহাস্যে উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই জানিতে পারেন। আমি ইতিহাসের ছাত্র। পাঠা পিটাইয়া মানুষ গড়িবার কর্ম করিয়া থাকি। কেহ কেহ আমাকে শিক্ষক বলিয়া থাকেন।’ আমি তাকে বললাম, ইতিহাস! তা বেশ। আচ্ছা, কার্জন হল ও পাঠাগার সম্পর্কে আমাকে কিছু জানাতে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই পারি। ১৯০৪ সালে ঢাকা প্রকাশ লিখিয়াছি, ঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এই কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের নিমিত্ত সুযোগ্য প্রিন্সিপাল ডাক্তার রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন। বড়লাট বাহাদুরের আগমন উপলক্ষে ভাওয়ালের রাজকুমারগণ এতদ অঞ্চলে লর্ড কার্জন বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্ত ‘কার্জন হল’ নামে একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণ বাবদ দেড় লাখ টাকা প্রদান করিয়াছেন।’

ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে পুরান ঢাকার উদ্দেশে বের হলাম। ’৪৭-এর দেশ ভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে এই স্থাপনাটি। এতশত বছর আগে কেমন ছিল মানুষের জীবন, কেমন করে এই ইংরেজ বাবুরা শোষণ করেছে আবার তৈরি করেছে কয়েকশ’ বছরের উন্নত চিন্তার স্থাপত্যশৈলী।

আরবি/ আরএফ

Link copied!