অ্যাজমা বা হাঁপানি মূলত এক ধরনের শ্বাসনালির রোগ। কোনো কারণে শ্বাসনালি অতি মাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়লে বাতাসের স্বাভাবিক চলাচল প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, এতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শ্বাসনানির ভেতরে ফুলে গেলে, অতিরিক্ত শ্লেষ্মা জমা হলে অথবা শ্বাসনালির পেশি শক্ত কিংবা সংকুচিত হয়ে গেলে অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা তৈরি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
কেন অ্যাজমা বা হাঁপানি হয় এটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। তবে বংশগত কারণেও কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বংশের কারও মধ্যে হাঁপানি থাকলে তা পরবর্তী প্রজন্মের যে কারও হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ হাঁপানি বা অ্যাজমায় আক্রান্ত। আর এক থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের এই রোগে আক্রান্তের হার বেশি।
বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস-২০২৩ প্রতিবেদনে শ্বাসতন্ত্রের রোগে দেশে মৃত্যুহারের বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে যে ১০টি রোগে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন, এরমধ্যে তৃতীয় নম্বরে আছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ আর পঞ্চম হলো অ্যাজমা।
চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের রোগে মারা গেছেন ০ দশমিক ৫৭ জন। অন্যদিকে গত বছর অ্যাজমায় প্রতি হাজারে ০ দশমিক ২৭ জন মারা গেছেন। এর আগের বছরেও শ্বাসতন্ত্রের রোগে ০ দশমিক ৫৬ জন ও অ্যাজমায় ০ দশমিক ২৮ জন মারা যান।
অন্যদিকে, শ্বাসতন্ত্রের চিকিৎসার জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজিজেস অফ দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটাল বা জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের তথ্যেও শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বিষয়টি উঠে এসেছে। গত বছর হাসপাতালটিতে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৯ জন। এছাড়া ২০২৩ সালে বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে মারা গেছেন ১ হাজার ৪৬ জন।
এ ক্ষেত্রে অ্যাজমা বা হাঁপানির চিকিৎসায় প্রায় ৫০ বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে মুখে খাবারযোগ্য ওষুধ স্টেরয়েড। তবে সম্প্রতি শ্বাসনালির এই রোগের চিকিৎসা নিয়ে নতুন গবেষণায় যুগান্তকারী সাফল্য পেয়েছেন গবেষকরা। লন্ডনের কিংস কলেজের ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, তীব্র অ্যাজমা বা হাঁপানির চিকিৎসায় স্টেরয়েডের থেকেও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফ্যাসেনরা ইনজেকশন বেশি কার্যকর। পাশাপাশি এই ইনজেকশন প্রয়োগের ফলে অ্যাজমা বা হাঁপানির চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসতে পারে।
রাসায়নিকভাবে ‘বেনরালিজুমাব’ নামে পরিচিত ‘ফ্যাসেনরা’ মূলত একটি অ্যান্টিবডি ড্রাগ। প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ইওসিনোফিলিক অ্যাজমা নামে একটি গুরুতর শ্বাসকষ্টের রোগের চিকিত্সায় এর অনুমোদন দিয়েছিল। মূলত ফুসফুসের প্রদাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্বেত রক্তকণিকাকে লক্ষ্য করে এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষকদের নেতৃত্বে করা ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, জীবনের ঝুঁকি রয়েছে এমন জরুরি পরিস্থিতিতেও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফ্যাসেনরা ইনজেকশন ব্যবহার করা যেতে পারে। হাসপাতালের পাশাপাশি এটি বাড়িতে বসেও দেয়া যায়। আবার এটি প্রয়োগে বারবার চিকিৎসা করা বা হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তাও কমে আসে।
গবেষকদের ভাষ্য, তীব্র অ্যাজমার ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় বারবার স্টেরয়েড বারবারের প্রয়োজন হয়, যার ফলে রোগীকে বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। নাহলে ৯০ দিনের মধ্যে মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে। তবে ফ্যাসেনরা ইনজেকশন ব্যবহারের ফলে চিকিৎসা করা বা হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা কমে আসে।
চিকিৎসা সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট রেসপাইরেটরি মেডিসিন’ এ নতুন এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিল ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড। এতে নেতৃত্ব দেয়া কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক মোনা বাফাডহেল এক বিবৃতিতে বলেন, অ্যাজমা ও সিওপিডি আক্রান্তদের চিকিৎসায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফ্যাসেনরা ইনজেকশন একটি যুগান্তকারী ফলাফল হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :