ঢাকা শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫

গভীর মহাবিশ্বের রহস্য

ডার্ক এনার্জির পরিবর্তন, চ্যালেঞ্জ করছে কি আইনস্টাইনকে?

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২৫, ০১:৫১ পিএম
ছবিঃ সংগৃহীত

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে চালিত করা রহস্যময় শক্তি বা ডার্ক এনার্জি হয়তো এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, যা আমাদের সময় ও স্থানের বর্তমান ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।

কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, আমরা হয়তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে আছি, যা আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে মূলগত ধারণা পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে।

এই নতুন পর্যবেক্ষণ আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তবে গবেষণায় জড়িত অনেক বিজ্ঞানী, এমনকি যারা সাধারণত সাবধানী, তারাও উত্তেজিত।  

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ওফার লাহাভ বলেন, এটি একটি নাটকীয় মুহূর্ত। আমরা হয়তো মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

ডার্ক এনার্জির রহস্য: মহাবিশ্বের আচরণ বদলাচ্ছে?

১৯৯৮ সালে যখন প্রথম ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়, তখন বিজ্ঞানীরা স্তম্ভিত হয়ে যান।  

বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীর হয়ে যাবে- এমনটাই ধারণা করছিলেন গবেষকরা। কিন্তু তখনকার পর্যবেক্ষণে দেখা গেল যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আসলে দ্রুততর হচ্ছে!

বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেননি, এই রহস্যময় শক্তি কী, তাই তারা নাম দিলেন ডার্ক এনার্জি- অর্থাৎ, এক অজানা শক্তি যা মহাবিশ্বকে প্রসারিত করছে।  

বহু বছর ধরে গবেষণার পর, বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে গ্যালাক্সিগুলোর দূরত্ব ও প্রসারণের হার পরিমাপ করে ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন।  

নতুন পর্যবেক্ষণ: সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে ডার্ক এনার্জি?

এই রহস্য উন্মোচনের জন্য কয়েকটি বৃহৎ গবেষণা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার মধ্যে অন্যতম ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্ট (DESI)। এটি যুক্তরাষ্ট্রের কিট পিক ন্যাশনাল অবজারভেটরিতে অবস্থিত এবং এতে ৫,০০০টি অপটিক্যাল ফাইবারের সমন্বয়ে তৈরি একটি বিশেষ টেলিস্কোপ রয়েছে, যা উচ্চগতিতে গ্যালাক্সিগুলো স্ক্যান করতে পারে।  

২০২৩ সালে ডিইআসআই (DESI)-এর বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন যে ডার্ক এনার্জির শক্তির পরিমাণ সময়ের সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে! প্রথমে অনেকে মনে করেছিলেন, এটি হয়তো পরিসংখ্যানগত একটি বিচ্যুতি মাত্র।  

কিন্তু এক বছর পর দেখা গেল, সেই ‘বিচ্যুতি’ এখন আরও শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে উঠে আসছে।  

পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেশাদ্রি নাদাথুর বলেন, প্রমাণ এখন আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী। আমরা আরও অনেক পরীক্ষা চালিয়েছি, যা নিশ্চিত করছে যে এটি কোনো ভুল বা ডেটার ত্রুটির কারণে হয়নি।

ডার্ক এনার্জি আরও অদ্ভুত কিছু!

যদিও এই নতুন গবেষণা এখনো একটি আনুষ্ঠানিক ‍‍`আবিষ্কার‍‍` হিসেবে স্বীকৃত হয়নি, তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।  

স্কটল্যান্ডের অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল, অধ্যাপক ক্যাথরিন হেইম্যানস বলেন, ডার্ক এনার্জি মনে হচ্ছে আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি অদ্ভুত!

তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালে এই নতুন ডেটা আসার পর সবাই সন্দিহান ছিল। কিন্তু এখন, আরও বেশি তথ্য ও গবেষণার পর, বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। এটা হয়তো একটা বিশাল আবিষ্কারের ইঙ্গিত দিচ্ছে!

কী হতে পারে এই পরিবর্তনের কারণ?

কেউ জানে না! অধ্যাপক ওফার লাহাভ হাসতে হাসতে বলেন, যদি এই ফলাফল সত্যি হয়, তবে আমাদের এমন একটি নতুন ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে যা এই পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে পারে। এর মানে হতে পারে, আমাদের বিদ্যমান তত্ত্বের পরিবর্তন দরকার!

এখন DESI আরও দুই বছর ধরে ডেটা সংগ্রহ করবে এবং প্রায় ৫০ মিলিয়ন গ্যালাক্সি ও উজ্জ্বল মহাজাগতিক বস্তু পরিমাপ করবে, যাতে বোঝা যায় এই পর্যবেক্ষণ কতটা নির্ভুল।  

লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী আন্দ্রেই কুসেউ বলেন, আমরা মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করি এবং তাকে বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু হয়তো মহাবিশ্ব আমাদের জানাতে চাইছে যে এটি আসলে আরও জটিল!

ভবিষ্যতের অনুসন্ধান: ইউক্লিড মিশন ও নতুন আবিষ্কার

DESI ছাড়াও, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) ইউক্লিড মিশন এই রহস্য উন্মোচনে আরও গভীরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এটি ২০২৩ সালে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে এবং এটি DESI-এর চেয়েও আরও বিস্তৃত ও গভীর পর্যবেক্ষণ করবে।  
ESA সম্প্রতি ইউক্লিড থেকে পাওয়া নতুন চিত্র প্রকাশ করেছে, যা ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি বুঝতে আরও সহায়ক হবে।  

পরবর্তী পদক্ষেপ: আইনস্টাইনের তত্ত্ব কি বদলে যাবে?

ডার্ক এনার্জি সম্পর্কিত এই গবেষণায় বিশ্বব্যাপী ৭০টিরও বেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ৯০০-র বেশি বিজ্ঞানী যুক্ত আছেন। যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটি, UCL এবং পোর্টসমাউথ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরাও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।  

যদি এই পর্যবেক্ষণ সত্য হয়, তাহলে আমাদের মহাবিশ্বের ভিত্তিগত ধারণাকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।  

বিজ্ঞানীরা বলেন, এখন আমরা শুধু অপেক্ষা করছি আরও বেশি তথ্যের জন্য। যদি এই পর্যবেক্ষণ সত্য হয়, তবে এটি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পর মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন হয়ে উঠবে!

আমরা কি নতুন পদার্থবিজ্ঞানের দ্বারপ্রান্তে?

এই পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত হলে, এটি শুধু ডার্ক এনার্জির ধারণাকেই বদলে দেবে না, বরং এটি পুরো মহাবিশ্বের গঠন, প্রসারণ এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।  

আমরা কি তাহলে একটি নতুন পদার্থবিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি

সম্ভবত, ভবিষ্যতের গবেষণা ও আবিষ্কারই আমাদের সেই উত্তর দেবে!

সূত্র: বিবিসি