রবিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৫

পরমাণু বোমার চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে ইএমপি

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৫, ০৫:৩৫ পিএম

পরমাণু বোমার চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে ইএমপি

ছবি: সংগৃহীত

কোনো একদিন হঠাৎ পুরো শহরে বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল ইন্টারনেট সব বন্ধ। রেডিও-টিভিও নীরব। ঘরে আলো নেই। বাইরে রাস্তার সব বাতিগুলো বন্ধ। দোকান-পাটের ডিজিটাল ক্যাশ মেশিনগুলো অচল। ব্যাংকের এটিএম থেকেও টাকা নেওয়া যাচ্ছে না। অফিসে যাওয়াও সম্ভব নয়। কারণ যানবাহন সব অচল। হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, চিকিৎসা সরঞ্জাম কাজ করছে না।

এমন পরিস্থিতি চলতে পারে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। এমন দৃশ্য কল্পনা করাই কঠিন। কিন্তু ইএমপি বা ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক পালস হামলায় এমনটা সত্যিই হতে পারে।

ইএমপি হলো তড়িৎ চুম্বকীয় তড়ঙ্গের তীব্র এক ঝটকা। যা কয়েক মুহূর্তেই বিস্তৃর্ণ এলাকার সব ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নষ্ট করে দিতে পারে। ইএমপির ফলে সরাসরি কোনো বিস্ফোরণ বা আগুন ধরে যায় না। কিন্তু এর প্রভাব পারমাণবিক বোমার থেকেও ভয়াবহ হতে পারে।

ইএমপি প্রাকৃতিকভাবেও তৈরি হতে পারে, সূর্যের সৌরঝড় বা বড় ধরণের বজ্রপাত থেকেও সৃষ্টি হতে পারে।

১৮৫৯ সালে কেরিংটন ইভেন্ট নামে এক শক্তিশালী সৌরঝড়ে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার অনেক স্থানে টেলিগ্রাফ লাইন একেবারে পুড়ে গিয়েছিল। আবার ১৯৮৯ সালে কানাডার কুইবেক প্রদেশ ১২ ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল একটি সৌরঝড়ের কারণে। তবে মানবসৃষ্ট ইএমপি এর চেয়েও অনেক ভয়ংকর হতে পারে।

ইএমপি দুটি পদ্ধতিতে ব্যবহার করা যায়- প্রথমটি হলো হাই-এলটিটিউট নিউক্লিয়ার ইএমপি বা এইচইএমপি। যেখানে বায়ুমন্ডলের উচ্চ উচ্চতায় একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই হাই-এলটিটিউটে বিস্ফোরণ ঘটলে সরাসরি আগুন বা বিস্ফোরণের আঘাত মাটিতে পৌঁছায় না। কিন্তু উৎপন্ন তীব্র ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক পালস পৃথিবীর বিস্তৃণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে হাজারো কিলোমিটার এলাকা স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে।

১৮৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টারফিশ প্রাইম পরীক্ষা এ ধরণের হামলার অন্যতম প্রমাণ হতে পারে। বিস্ফোরণ স্থলের প্রায় ১৫’শ কিলোমিটার দূরে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের গোটা বিদ্যুৎব্যবস্থাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ইএমপির প্রভাবে।

একই ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নও। তারা দেখিয়েছিল ইএমপির কারণে শত শত কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন ও ভূগর্ভস্থ যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে পুড়ে যায়।

দ্বিতীয়টি হলো নন-নিউক্লিয়ার ইএমপি বা ই বোমা। এটি মূলত উচ্চ ক্ষমতার মাইক্রোওয়েভ বা বিশেষ বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ই বোমায় কোনো পারমাণবিক বিস্ফোরণ না হলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ইএমপির সৃষ্টি করে এর মাধ্যমে সামরিক বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ইলেকট্রিক সরঞ্জাম অচল করে দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টার-ইলেক্ট্রনিক্স হাই পাওয়ার মাইক্রোওয়েভ অ্যাডভান্সড মিসাইল প্রজেক্ট (সিএইচএএমপি বা চ্যাম্প), রাশিয়ার এলাভোগা প্রকল্প এবং চীনের উন্নত মাইক্রোওয়েভ অস্ত্র এই ধরনের ই বোমার উদাহরণ।

ইএমপি হামলার পর দৈনন্দিন জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। বিদ্যুৎনির্ভর আধুনিক প্রযুক্তিগুলো স্থবির হয়ে পড়বে। পচনশীল খাদ্যদ্রব্য দ্রুত নষ্ট হতে শুরু করবে। ব্যস্ত শহরগুলোতে পানীয় জলের অভাব দেখা যাবে, কৃষিযন্ত্র অকেজো হয়ে খাদ্য উৎপাদনও থমকে যাবে। বিদ্যুৎ না থাকায় সরবারাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।

চারদিকে তীব্র মানবিক ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি হবে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ায় পরিবেশ দূষিত হবে। এবং রোগ-ব্যাধিও দ্রুত বিস্তার লাভ করবে। বিদ্যুতের অভাবে হাসপাতালগুলো কার্যত বন্ধ থাকবে। জরুরী ঔষধ ও সরঞ্জাম সরবরাহের ঘাটতিতে রোগী ও লাশের সারি বাড়তে থাকবে।

ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের ডিজিটাল ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে। নগদ টাকার জোগান সীমিত থাকায় মানুষের হাতে টাকা থাকবে না। অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। চারদিকে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। জীবন হয়ে উঠবে অস্থির ও অসহনীয়।

তবে ইএমপি থেকে সুরক্ষার উপায় রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ আগাম সতর্কতা হিসেবে ফারাডি কেইস বা বিশেষ ধাতব আবরণের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করছে অনেক আগে থেকেই। তারা সামরিক ও সরকারি স্থাপনায় ইএমপি প্রতিরোধী হারডেনিং প্রতিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। ইএমপি হামলা মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক নানা মহড়ার আয়োজন করে। অনেক দেশে মানুষকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সরঞ্জাম মজুদ রাখার পরামর্শও দেয়া হয়।

ইএমপি হলো আধুনিক বিশ্বের অদৃশ্য এক নীরব শত্রু। পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের চেয়েও ইএমপির প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। কারণ এটি একটি জাতির প্রযুক্তিনির্ভর হৃদপিন্ডে আঘাত হানে। এবং ধীরে ধীরে সেই জাতিকে অচল করে দিতে পারে। ইএমপি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আগে থেকে নিলে ভবিষ্যতে এই নীবর বিস্ফোরণ মানব সভ্যতাকে আর মধ্যযুগে নিয়ে যেতে সুযোগ পাবে না।

আরবি/এসএমএ

Link copied!