ঢাকা শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

পুলিশের গুলিতেই মুগ্ধ নিহত হয়েছে

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৫, ১২:২৫ পিএম

পুলিশের গুলিতেই মুগ্ধ নিহত হয়েছে

ছবি: সংগৃহীত

কোটা সংস্কারের দাবিতে সেদিন ঢাকা ছিল বিক্ষোভে উত্তাল। একদিকে ছাত্রদের বিক্ষোভ অন্যদিকে পুলিশি অ্যাকশন। ওইদিন আন্দোলনকারীদের হাতে পানির বোতল তুলে দিচ্ছিলেন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। টি-শার্টের হাতা দিয়ে টিয়ার গ্যাসের জ¦লতে থাকা চোখ মুছতে মুছতেই সবার মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছিলেন পানির বোতল। হঠাৎ মুগ্ধ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটে পড়েন রাস্তায়। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। মুহূর্তেই মুগ্ধর রক্তে যখন রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল, তখন তার বন্ধুরা বহু সংগ্রাম করেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিতে পারেননি। অসংখ্য পুলিশ অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পর রিকশায় করে মুগ্ধকে নিকটস্থ ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি ঘটেছিল গত ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে।

জানা গেছে, মুগ্ধ বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনলাসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী ছিলেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালে গণিতে স্নাতক পাসের পর বিইউপি থেকে এমবিএ করছিলেন তিনি। মৃত্যুর সময় তার গলায় রক্তমাখা বিইউপির আইডি কার্ড ছিল।

মুগ্ধ নিহতের ছয় মাস পরে গতকাল বৃহস্পতিবার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছে তার পরিবার। কারো নাম উল্লেখ না করে পরিবারের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ অভিযোগ করেন মুগ্ধর জমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।

অভিযোগ দায়েরের পর ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চিফ প্রসিকিউটরের সঙ্গে দেখা করেছি। নির্দিষ্ট কারো নাম না উল্লেখ করে শুধু অভিযোগ দায়ের করেছি। ট্রাইব্যুনাল তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণাদিসহ যে বা যারা প্রকৃত অপরাধী এবং যারা তাদের এই অপরাধ করতে সাহায্য করেছে, তাদের মামলায় অপরাধী হিসেবে নিয়ে আসবেন।’

তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল আমাদের ন্যায় বিচারের আশা পূরণে সক্ষম হবেন।’
তিনি আরও বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাক্ষ্য-প্রমাণ। এটি মূলত প্রশাসনের দায়িত্ব হলেও আমরা নিজেরাই বেশকিছু প্রমাণাদি সংগ্রহ করেছি। কারণ বিচার ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হোক বা ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াতে সময় লাগুক তা চাইনি। আমরা চাই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা দ্রুততার সঙ্গে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করবেন, এখানে প্রমাণ সংগ্রহ করে আমরা তাদের কাজ অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছি।’

দীপ্ত বলেন, মুগ্ধ যেখানে মারা যায় তার ১০ কদম দূরেই হাসপাতাল ছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে স্পট ডেড ঘোষণা করেন। সেখানে আমাদের পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তখন হাসপাতালে ডাক্তাররা আমাদেরকে বারবার বলছিল লাশ দিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ পুলিশ আসার পরবর্তীতে আমরা লাশ নাও পেতে পারি। পরে সেখান থেকে ডেট সার্টিফিকেট নিয়ে আমরা দ্রুত বাসায় লাশ নিয়ে যাই।

তিনি আরও বলেন, মুগ্ধের লাশ কবরস্থ করার সময়ও আমাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। লাশ দাফন করার জন্য পুলিশের এনওসির প্রয়োজন হয়। এর জন্য আমরা থানায় গিয়েছি। কিন্তু থানা থেকে আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, তাদের এখন কলমের একটি দাগ দেওয়ার পর্যন্ত অনুমতি নেই।

মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, ‘১৮ জুলাই মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তারা বারবার লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য বলতে থাকেন, কারণ পুলিশ এসে লাশ সরিয়ে ফেলার একটি সম্ভাবনা ছিল। লাশ দাফন করার জন্য থানায় অনাপত্তিপত্র নিতে গেলে তারা অনুমতি নেই বলে জানায়।’

স্নিগ্ধ গণমাধ্যমের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে তথ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ করেছি, তার ভিত্তিতে বলতে পারি যে, পুলিশের চালানো গুলিতেই সেদিন মুগ্ধর জীবন চলে গেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সত্যতা প্রমাণ করা কঠিন কোনো বিষয় নয়।’

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে মুগ্ধর বন্ধু আশি জানান, মুগ্ধ ও তাদের বন্ধু জাকির আন্দোলনের মাঝেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রোড ডিভাইডারের ওপর বসেছিলেন। হঠাৎ সবাই আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের ওইদিক থেকে দৌড়ে আসছে। আমরা দেখলাম, কিছুটা ধীরগতিতেই উঠব ভাবলাম, দুই-তিন সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের ওপরে হাত রেখে বললাম চল দৌড় দেই। আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বলল চল।

তিনি বলেন, এরপর প্রথমে জাকির উঠে দৌড় দিল এবং তারপর আমি। কিন্তু তিন থেকে চার কদম যাওয়ার পর আমার সামনেই জাকিরকে দেখছি দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমার পাশে মুগ্ধ নেই! থেমে গেলাম, পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়ছে, চোখ দুটো বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন। আমি চিৎকার করলামÑ জাকির, মুগ্ধ গুলি খাইসে!
 

আরবি/জেআই

Link copied!