অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে চিন্তায় থাকেন, কিন্তু নিম্ন রক্তচাপ বা হাইপোটেনশন নিয়ে ততটা আলোচনা বা জানা হয়ে ওঠে না আমাদের। অথচ এটি স্বাস্থ্যের জন্য কখনো আশীর্বাদ, আবার কখনো হতে পারে ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ!
আপনি কি জানেন, অতিরিক্ত কম রক্তচাপ মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারে? এতে সৃষ্টি হতে পারে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা শকে চলে যাওয়ার মতো জটিল অবস্থা।
নিম্ন রক্তচাপ বা লো প্রেশার কাকে বলে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন শরীরে রক্তচাপ ৯০/৬০ এমএমএইচজি (mmHg) বা তার কম হয়, তখন তাকে নিম্ন রক্তচাপ বলা হয়। যদিও অনেকের স্বাভাবিক রক্তচাপ তুলনামূলক কম থাকে, কিন্তু যদি এটি হঠাৎ করে কমে যায় বা শারীরিক সমস্যা তৈরি করে, তাহলে এটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

নিম্ন রক্তচাপের লক্ষণ ও ঝুঁকি
যারা নিম্ন রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের মধ্যে সাধারণত নিম্নলিখিত ৯টি লক্ষণ দেখা যায়—
১. মাথা ঘোরা
২. দুর্বল লাগা
৩. অজ্ঞান হওয়া
৪. বমি বমি ভাব
৫. শ্বাসগতি দ্রুত হয়ে যাওয়া
৬. দুর্বল বা দ্রুত নাড়ীর স্পন্দন
৭. হঠাৎ করে চোখের সামনে অন্ধকার দেখা বা ঝাপসা দেখা
৮. মনোযোগের ঘাটতি
৯. ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে ও ফ্যাকাশে ত্বক
এ ছাড়াও ব্যথা, প্রস্রাব কমে যাওয়া, খুব বেশি তৃষ্ণা অনুভূত হওয়া বা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে হঠাৎ মাথা ঘুরে যাওয়া বা ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলোও দেখা দিতে পারে।
বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিরা, গর্ভবতী নারী, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা নিম্ন রক্তচাপে বেশি ভুগে থাকেন।

কেন হয় নিম্ন রক্তচাপ?
নিম্ন রক্তচাপের বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে মূল কিছু কারণ নিচে তুলে ধরা হলো-
ডিহাইড্রেশন – পর্যাপ্ত পানি বা তরল না খেলে রক্তের পরিমাণ কমে যেতে পারে। ফলে লো প্রেশারের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পুষ্টিহীনতা – বিশেষ করে ভিটামিন বি-১২ ও ফোলেটের অভাবে শরীরে রক্তচাপ কমে যায়।
হৃদরোগ – হার্টের পাম্পিং দুর্বল হলে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত হয় না শরীরে লো প্রেশার দেখা দিতে পারে।
এন্ডোক্রাইন সমস্যা – থাইরয়েডের সমস্যা বা অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ডের অস্বাভাবিকতা শরীরে রক্তচাপ কমিয়ে দিতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – কিছু ওষুধ যেমন ডিপ্রেশন, পারকিনসনস বা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ শরীরে লো প্রেশার তৈরি করতে পারে।
নিম্ন রক্তচাপ হলে কী করবেন?
যদি হঠাৎ করে মাথা ঘুরে যায় বা অজ্ঞান হওয়ার অনুভূতি হয়, তাহলে দ্রুত বসে পড়ুন বা শুয়ে পড়ুন এবং পা উঁচু করে দিন। এটি রক্তকে মস্তিষ্কের দিকে প্রবাহিত হতে সাহায্য করবে।
চিকিৎসকদের মতে, নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান করা, লবণযুক্ত খাবার খানিকটা বেশি খাওয়া, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানো, বেশি সময় দাঁড়িয়ে না থাকা ও ক্যাফেইন গ্রহণ করা কিছু ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। তবে যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
নিম্ন রক্তচাপ কি ভালো নাকি খারাপ?
আপনার মনে এখন প্রশ্ন আস্তেই পারে যে, এত সমস্যা জানার পরে তো এমন কথা জিজ্ঞাসা করাই বোকামি যে নিম্ন রক্তচাপ কি ভালো নাকি খারাপ। তবে জেনে নিন, এটি নির্ভর করে ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার ওপর।
অনেক অ্যাথলেট বা স্বাস্থ্যকর জীবনীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির রক্তচাপ তুলনামূলক কম থাকতে পারে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু যদি এটি মাথা ঘোরা, দুর্বলতা বা অন্যান্য উপসর্গ তৈরি করে, তবে এটি বিপজ্জনক হতে পারে।
লো ব্লাড প্রেশারে কী খাবেন
যাদের রক্তচাপ প্রায়ই কম থাকে, বা কায়িক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের কারণে ব্লাড প্রেশার কমে যায়, তারা কিছু নির্দিষ্ট খাবার নিয়মিত খেলে রক্তচাপ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে পারে।
যেসব খাবার রক্তচাপ বাড়াতে সাহায্য করে তার একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো -
আয়রন, ভিটামিন সি, বি১২ ও ফলেট
এই পুষ্টিগুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই এসব পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খাওয়া উচিত।
ডিম
ডিমে ভিটামিন বি১২ আছে, যা হাইপোটেনশনের রোগীদের জন্য উপকারী।
তরল খাবার
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যুপ, কফি, ফলের রস, দুধ ও শরবত পান করা উচিত।

টক জাতীয় ফল
লেবু, মালটা, কমলালেবুর মতো ফলে ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে, যা সোডিয়ামের কার্যকারিতা ঠিক রাখে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
আয়রনসমৃদ্ধ খাবার
গরু ও মুরগির মাংস, সামুদ্রিক মাছ, ডাল, লাল শাক, পালং শাক, কচু শাক, সিমের বিচি, মিষ্টি কুমড়ার বিচি ও শুকনা ফল আয়রনের ভালো উৎস। এতে সোডিয়ামও থাকে, যা রক্তচাপ বাড়াতে সহায়ক।
ডাবের পানি
ডাবের পানিতে সোডিয়াম থাকে, যা লো ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
ডার্ক চকলেট
যাদের প্রেশার খুব কমে যায়, তারা ডার্ক চকলেট খেলে উপকার পেতে পারেন।
তাৎক্ষণিক প্রেশার কমে গেলে করণীয়
স্যালাইন
লো প্রেশার হলে স্যালাইন পান করা খুব উপকারী, কারণ এটি দ্রুত রক্তচাপ বাড়াতে সাহায্য করে।
লবণ-পানি
এক গ্লাস পানিতে সামান্য লবণ ও চিনি মিশিয়ে খেলে রক্তচাপ বাড়তে পারে।

আঙ্গুরের রস
এটি প্রেশার বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত উপকারী।
লবণযুক্ত খাবার
চিপস, স্যুপ বা লবণসমৃদ্ধ খাবার দ্রুত রক্তচাপ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
নিম্ন রক্তচাপও অবহেলা করার মতো কোনো বিষয় নয়। লো ব্লাড প্রেশার হলে সঠিক খাবার নির্বাচন ও পর্যাপ্ত তরল গ্রহণের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে অবশ্যই নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন এবং যদি লক্ষণ অনুভব করেন, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন!
আপনার মতামত লিখুন :