টেস্টোস্টেরন হরমোন সম্পর্কে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পুরুষদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এই হরমোনের মাত্রা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
চলুন, বিস্তারিতভাবে জেনে নিই টেস্টোস্টেরন হরমোনের ভূমিকা, ঘাটতি হলে কী হয়, অতিরিক্ত হলে কী সমস্যা দেখা দেয় এবং কীভাবে এর ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
টেস্টোস্টেরন হরমোনের ভূমিকা
টেস্টোস্টেরন হরমোন মূলত পুরুষদের শরীরে বেশি সক্রিয় হলেও এটি নারীদের শরীরেও স্বল্প পরিমাণে উৎপন্ন হয়। এটি প্রধানত শুক্রাশয় (testis) ও আংশিকভাবে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হয়।
নারীদের ক্ষেত্রে এটি ওভারির মাধ্যমেও তৈরি হয়।
এই হরমোনের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তন: টেস্টোস্টেরন হরমোন বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের দেহে নানা পরিবর্তন ঘটায়, যেমন- জননাঙ্গের বৃদ্ধি, গোঁফ-দাড়ি গজানো, পেশিশক্তি বৃদ্ধি ও কণ্ঠস্বর ভারী হওয়া।
যৌন ক্ষমতা ও প্রজনন: এটি পুরুষদের যৌন ক্ষমতা ও শুক্রাণু উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পেশির গঠন ও হাড়ের মজবুত করা: এই হরমোন পেশি বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং হাড়কে মজবুত রাখে।
মানসিক স্বাস্থ্য: এটি আত্মবিশ্বাস, উদ্দীপনা ও মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
শারীরিক কর্মক্ষমতা: এটি শক্তি ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।

টেস্টোস্টেরন হরমোনের ঘাটতিতে কী হয়?
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমতে থাকে। তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণেও এই হরমোনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
যৌন ক্ষমতা হ্রাস: টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে গেলে যৌন ইচ্ছা কমে যায় এবং ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের (লিঙ্গের দৃঢ়তা ধরে রাখার সমস্যা) সৃষ্টি হতে পারে।
শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া: কম মাত্রার টেস্টোস্টেরন পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।
শারীরিক দুর্বলতা ও অবসাদ: এটি কমে গেলে সহজেই ক্লান্তি আসে এবং সারাদিন শরীর দুর্বল লাগে।
চুল পড়া ও টাক সমস্যা: টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি হলে মাথার চুল দ্রুত পড়ে যেতে পারে।
পেশিশক্তি হ্রাস ও হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া: এটি কমে গেলে পেশি দুর্বল হয় এবং অস্টিওপোরোসিস (হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া) হতে পারে।
মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া: টেস্টোস্টেরনের অভাবের কারণে মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিতে পারে।
শরীরে চর্বি জমা: হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে পেটের চর্বি বেড়ে যেতে পারে।
টেস্টোস্টেরন হরমোনের ঘাটতির কারণ
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে, যেমন-
- অণ্ডকোষের সংক্রমণ বা আঘাত
- কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল ও ধূমপান
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বা স্থূলতা
- শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া
- পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা
- অনিদ্রা ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব
টেস্টোস্টেরন হরমোন অতিরিক্ত হলে কী হয়?
যেমন টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি অতিরিক্ত মাত্রাও বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করতে পারে।
- শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যেতে পারে
- হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে
- প্রোস্টেটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রস্রাবে সমস্যা দেখা দিতে পারে
- আচরণগত সমস্যা ও অতিরিক্ত আগ্রাসী মনোভাব দেখা যেতে পারে
- অনিদ্রা, মাথাব্যথা ও উদ্বেগ বাড়তে পারে
- ওজন দ্রুত বেড়ে যেতে পারে
- কিশোরদের ক্ষেত্রে উচ্চতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে
টেস্টোস্টেরন হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার উপায়

টেস্টোস্টেরন হরমোনের সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার গুরুত্ব অনেক বেশি।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বাদাম ও সয়াবিন হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সবুজ শাকসবজি খান: ব্রকোলি, পালংশাক, গাজর, বীট ও টমেটোর মতো সবজি হরমোন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ফলমূল যোগ করুন: আপেল, কলা, ডালিম ও আঙুরের মতো ফল হরমোনের কার্যকারিতা বাড়ায়।
চা পান করুন: হার্বাল টি (গ্রিন টি বা আদা চা) হরমোন ব্যালেন্স করতে সাহায্য করে।
প্রচুর পানি পান করুন: শরীরের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সচল রাখতে পানি অপরিহার্য।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন: বিশেষ করে ওয়েট লিফটিং ও কার্ডিও ব্যায়াম হরমোন বৃদ্ধি করে।
ভিটামিন ডি গ্রহণ করুন: সূর্যালোক গ্রহণ ও ডিমের কুসুম, টুনা মাছের মতো খাবার থেকে ভিটামিন ডি পেতে পারেন।
পর্যাপ্ত ঘুমান: প্রতি রাতে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
স্ট্রেস কমান: অতিরিক্ত মানসিক চাপ এড়িয়ে চলুন এবং ধ্যান বা যোগব্যায়াম অভ্যাস করুন।
টেস্টোস্টেরন হরমোন শুধু পুরুষদের জন্যই নয়, বরং নারীদের শরীরেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ভারসাম্য ঠিক রাখতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা জরুরি। হরমোনের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায় বা বেড়ে যায়, তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সুস্থ থাকুন, ফিট থাকুন!