গরম পানিতে লেবু খাওয়ার উপকারিতা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম

গরম পানিতে লেবু খাওয়ার উপকারিতা

ছবি: সংগৃহীত

স্বাস্থ্যসচেতনদের পছন্দের তালিকায় সবসময়ই যে পানীয় থাকে তা হলো লেবু–পানি। দিনের শুরু থেকে খাওয়ার আগে-পরে, এক গ্লাস লেবু–পানি খাওয়া অনেকেরই রোজকার রুটিনের অংশ। যেকোনো সময় লেবু–পানি খেলেই যে সমান উপকারিতা মেলে, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং সময়ভেদে বদলে যায় লেবু–পানির উপকারিতা। আবার উপকারিতার ওপর ভিত্তি করে আপনিও বদলে নিতে পারেন লেবু–পানি খাওয়ার সময়। একনজরে দেখে নিন কখন লেবু–পানি খেলে কেমন উপকার পেতে পারে আপনার শরীর।

লেবু–পানি খেলে যে যে উপকার পাওয়া যায়

শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়: 

লেবু খানিকটা অ্যাসিডিক সেটা ঠিক আছে কিন্তু এর উপকারিতাও তো অবহেলা করার মতো নয়। ক্ষারীয় এই খাবারটি আপনার শরীরে পিএইচের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার কাজে উপকারী। তাইতো ডাক্তাররা বলেন,  হালকা গরম পানিতে লেবুর রস খাওয়ার অভ্যাসটির উপকারিতা অনেক। এর ফলে যেমন লিভার ভালো থাকে তেমন শরীর থেকে নানান টক্সিন বেরিয়ে যায় সহজে।

হজমে সাহায্য করে: 

এই সাধারণ কিন্তু শক্তিশালী পানীয়টি হজমে সাহায্য করে ব্যাপকভাবে।  খাবারের পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ থেকে শুরু করে সঠিকভাবে পাঁচন প্রক্রিয়া পর্যন্ত পুরোটাই খুব সহজে করে লেবুপানি।

ওজন ঝড়ানোর ওস্তাদ: 

লেবুর রসে পেকটিন নামে একটি উপাদান থাকে যেটা কিনা ওজন কমাতে সহায়ক। যদি সকালে উঠেই চিনি দেওয়া এককাপ চা বা মধু খাওয়া আপনার অভ্যাস হয়ে থাকে, তবুও উষ্ণ পানিতে লেবুর রস মেশানো পানীয়টি খান। দৈনন্দিন খাবার তালিকা থেকেই গৃহীত ক্যালোরি ঝড়াতে প্রচুর কাজে আসবে এই পানীয়টি।

গ্যাসের সমস্যা কমায়:

 রাতের বেলা ভরপেট খাবার খাওয়ার পর প্রায়ই বেশ অস্বস্তি বোধ করেন অনেকে। শুরু হয় বুক জ্বলুনিও। সেই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হালকা গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খেতে পারেন।  হালকা গরম পানি হজমে সাহায্য করবে আর লেবুর রস পাকস্থলীতে তৈরি হওয়া গ্যাসের সমস্যা থেকে রক্ষা করবে। খুব সহজেই আবার অনেকটাই সুস্থ বোধ করতে শুরু করবেন আপনি।

কখন লেবু–পানি খেলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাবেন

খাওয়ার আগে লেবু–পানি খেলে যা হয়

খাওয়ার ঠিক আগে এক গ্লাস লেবু–পানি খেলে তা ক্ষুধা বাগে আনে। লেবু–পানিতে অম্লতা বেশি, যা খাবার হজমের জন্য পেটকে প্রস্তুত করে। এতে খাবারের পুষ্টিগুণ সহজে শোষিত হয়। এ ছাড়া খাওয়ার আগে এক গ্লাস লেবু–পানি খেলে তা ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে। এতে খাওয়ার সময় অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের হার কমায়।

খাওয়ার পরে লেবু–পানি খেলে যা হয়

লেবুতে আছে প্রচুর সাইট্রিক অ্যাসিড, যা পাকস্থলীতে গিয়ে হজমে সাহায্য করে। ভারী খাবার খাওয়ার পর লেবু–পানি খেলে হজমের কাজটা সহজ হয়। ভারী খাবার খাওয়ার পর যে অস্বস্তি তৈরি হয়, তা–ও অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে লেবু–পানি। বদহজম বা অম্বলের সমস্যাতেও উপকারী হতে পারে লেবু–পানি। এ ছাড়া খাওয়ার পর পাকস্থলীর পিএইচ মান নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে লেবু–পানির তুলনা কমই আছে। শরীরে বেশির ভাগ সমস্যার সূচনা হয় পানিশূন্যতা থেকে। কুসুম গরম লেবু–পানি শরীরের পানিশূন্যতা পূরণে সাহায্য করে।

রাতে লেবু পানি পানের  উপকারিতা

যুক্তরাষ্ট্রের ‘লেটস গেট চেকড’য়ের সনদস্বীকৃত পুষ্টিবিদ মেগান এরউইন বলেন, “সারাদিনের যেকোনো সময় লেবু পানি পান করার মাধ্যমে শরীরে পানি আর ভিটামিন সি, দুটি অত্যন্ত উপকারী উপাদানের যোগান দেওয়া সম্ভব। তবে রাতে ঘুমানো আগে পান করাটা উপকারী হবে কি-না, নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির ওপর।”

কুসুম গরম লেবু পানি শরীরে আরাম দেবে, যা মানসিক চাপ কমাতে ভালো ঘুম আনবে। আবার সন্ধ্যার দিকে চুমুকে চুমুকে লেবু পানি পান করা হবে স্বাস্থ্যকর বিকল্প।

“তবে রাতে ঘুমানোর ঠিক আগেই পানীয় পান করার কারণে ঘুমের মাঝে মুত্রত্যাগের বেগ চাপতে পারে। যাদের বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা আছে তাদের জন্য ঘুমানো আগে লেবু পানি হবে যথেষ্ট ক্ষতিকর। তাই বৃদ্ধিমানের কাজ হবে একদিন তা পান করে শরীরের প্রতিক্রিয়া বোঝা।”

যদি কোনো সমস্যা দেখা না দেয় তবে রাতে ঘুমানো আগে লেবু পানি করা অপকারী হবে না।

সকালে গরম পানিতে লেবু পান করলে যেসব ক্ষতি

গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যখন ঘুম থেকে জেগে উঠি, তখন আমাদের দেহের টক্সিন থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং সেইসাথে আমাদের কোষগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য হাইড্রেশন প্রয়োজন হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই মানুষজন পানির স্বাদহীন প্রকৃতি পছন্দ করেন না।  অনেকেই হালকা গরম পানিতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে পান করাকে আকর্ষণীয় মনে করেন। পানিতে স্বাদ যোগ করার পাশাপাশি, লেবুর রস আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টিকর পানীয়। এই লেবু পানি পানীয়টি প্রতিদিন সকালে খালি পেটে গরম পানিতে পান করলে আপনার শরীরের জন্য উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে।

আসুন প্রতিদিন সকালে খালি পেটে লেবুর গরম পানি পান করা শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা দেখে নেই ।

ক্ষতিকর এনজাইম তৈরি করে:

খালি পেটে লেবু পানি খেলে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক পেপসিন ভেঙে যায়। পেপসিন আমাদের হজমে সাহায্য করে। লেবুর মধ্যে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড পেপসিনকে ভেঙে ক্ষতিকর এনজাইম তৈরি করে। ফলে খাবার ঠিকমতো হজম হয় না।

দাঁতের ক্ষতি করতে পারে:

প্রতিদিন সকালে খালি পেটে উষ্ণ পানিতে লেবুর রস যোগ করার ফলে আপনার দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। গরম লেবু পানি পান করা এটি আপনার দাঁতকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ লেবু অত্যন্ত অ্যাসিডিক এবং ঘন ঘন ব্যবহার বা পান করলে তা আপনার দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে। তাই প্রতিদিন সকালে বেশি সময় ধরে লেবু পানি পান করা এটি আপনার দাঁতের জন্য খুব একটা ভালো নয়।

হাড়ের উপর প্রভাব ফেলে:

অতিরিক্ত লেবু গরম পানি প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করলে তা আপনার হাড়ের ক্ষতি করতে পারে। আপনি যদি প্রতিদিন সকালে প্রচুর পরিমাণে লেবুর রস পান করেন, তবে এটি আপনার হাড়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। দেখা গেছে যে অধিক লেবুর পানি পান করার ফলে, তা হাড়ের জয়েন্টে তেলকে ধীরে ধীরে শোষণ করে যা ভবিষ্যতের জন্য আপনার হাড়ের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ঘন ঘন প্রস্রাব এবং ডিহাইড্রেশন:

পানিতে প্রচুর পরিমাণে লেবুর রস যোগ করেন তাহলে আপনার মূত্রবর্ধক প্রভাব হতে পারে। তবে খুব বিরল ক্ষেত্রে লেবুর রস একটি মূত্রবর্ধক প্রভাব তৈরি করে থাকে। লেবুর রসে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড বা ভিটামিন সি বেশি পরিমাণে থাকে যা মূত্রবর্ধক। এটি কিডনিতে প্রস্রাব উৎপাদনকে উৎসাহিত করে থাকে। তাই এটি শরীরকে অতিরিক্ত লবণ এবং তরল দ্রুত মুক্তি পেতে সহায়তা করে থাকে।

মাইগ্রেন সমস্যা হতে পারে:

লেবুর গরম পানি পান করার ফলে আপনার মাইগ্রেন সমস্যা হতে পারে। কিছু মানুষের জন্য, লেবুর মতো সাইট্রাস খাবার মাইগ্রেনে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। উপরন্তু, আপনি যদি মাইগ্রেন সমস্যা অনুভব করেন বা ভোগেন, তাহলে পরিমানের চাইতে বেশি লেবু খেলে আপনার অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। এতে মাইগ্রেন সমস্যা আরোও দ্বিগুন হতে পারে।

আয়রনের পরিমাণ বাড়াতে পারে:

প্রতিদিন সকালে খালি পেটে লেবু গরম পানি পান করেন তাহলে তা আপনার আয়রন সামগ্রী বাড়াতে পারে। লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে যা শরীরে নন – হিম আয়রনের শোষণ বাড়াতে দায়ী থাকে। আপনার যদি হেমোক্রোমাটোসিস অবস্থা থাকে, যার কারণে আপনার শরীর অতিরিক্ত আয়রন সঞ্চয় করে থাকে। এর ফলে শরীরের অতিরিক্ত আয়রন আপনার অঙ্গগুলোর ক্ষতি করতে পারে।

জিইআরডি এবং আলসারের কারণ:

অতিরিক্ত লেবু গরম পানি পান করলে বমি বমি ভাব হতে পারে। কারণ লেবুতে অ্যাসিড থাকার ফলে এটি হয়। জিইআরডি কে গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিসঅর্ডার হিসাবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে । সাধারণত মশলাদার, চর্বিযুক্ত এবং অ্যাসিডিক খাবার যেমন লেবুর দ্বারা উদ্ভুত হয়। যা সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে বমি বমি ভাব এবং বমি অন্তর্ভুক্ত। অধিকন্তু, যদি আপনার আলসার থেকে থাকে , তবে অনেক বেশি অ্যাসিডিক খাবার বা পানীয় গ্রহণ করার ফলে আপনার স্টপ লাইনিংকে বিরক্ত করতে পারে। যা নিরাময় প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

পেট খারাপ হতে পারে:

লেবু গরম পানি পান করার কারণে আপনার পেট খারাপ করতে পারে। এটি অধিক পানে বা ব্যবহারে আপনার পেট খারাপ করতে পারে এবং এমনকি আপনার গ্যাস্ট্রো জটিলতাকে সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে ।

অম্বলকে ট্রিগার করতে পারে:

প্রতিদিন সকালে খালি পেটে লেবু গরম পানি পান করার কারণে অম্বলকে ট্রিগার করতে পারে বা এটি আরও খারাপ এর দিকে নিয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনি নিয়মিত অম্বল অনুভব করে থাকেন। অম্বল, যা অ্যাসিড রিফ্লাক্স নামেও পরিচিত। যখন এটি ঘটে থাকে তখন খাদ্যনালীর স্ফিঙ্কটার সঠিকভাবে কাজ করতে বাধার সৃষ্টি করে বা ব্যর্থ হয় এবং পাকস্থলীর অ্যাসিডকে রিফ্লাক্স নামক প্রক্রিয়ায় খাদ্যনালীতে ফিরে যেতে দেয়।

স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি না হওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে লেবুর রস না খাওয়া উত্তম এবং খুব বেশি লেবুর রস ব্যবহার না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যদি প্রতিদিন সকালে আপনি লেবু গরম পানি পান করেন তবে লেবু রসের পরিমাণ কম যোগ করার কথা চিন্তা করুন এবং লেবুর প্রভাব কমানোর জন্য সাথে এক চা চামচ মধু যোগ করুন। প্রতিদিন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ খেলে লেবু বা সাইট্রিক জাতীয় ফল এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এছাড়াও ক্যালসিয়ামের ওষুধ খেলে সঙ্গে লেবু খাবেন না, এতে হিতে বিপরীত হবে।

জেনে রাখা ভালো

লেবু–পানি খাওয়ার সঠিক কোনো নিয়মকানুন নেই। চাহিদামতো যেকোনো সময় খেতে পারেন। তাই আপনার জীবনযাপন এবং শরীরের অবস্থার বুঝে লেবু–পানি খাওয়ার সময় ঠিক করে নিন। তবে আর যাই করুন, একদম খালি পেটে লেবু–পানি খাবেন না। খালি পেটে লেবু–পানির অম্লতা ভালোর বদলে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া এটি দাঁতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই লেবু–পানি খাওয়ার পর কুলকুচি করে নেওয়া ভালো। এতে দাঁতের এনামেলের ক্ষতি হবে না। উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে নিয়মিত লেবু–পানি খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

আরবি/শিতি

Link copied!