ঢাকা সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০২৫

মেয়েদের হরমোনের সমস্যা বোঝার উপায় ও সমাধান

লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
ছবি: সংগৃহীত

হরমোন হল দেহের রাসায়নিক বার্তাবাহক, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। মেয়েদের হরমোনের ভারসাম্যহীনতা অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশে অনেক নারীই হরমোনজনিত সমস্যার সম্মুখীন হন, তবে অনেক সময় তারা বুঝতে পারেন না যে সমস্যার মূল কারণ হরমোনের অসামঞ্জস্যতা। আজ আমরা মেয়েদের হরমোনজনিত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করার উপায়, সেগুলো প্রতিরোধের পদ্ধতি, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।  

মেয়েদের হরমোনের সমস্যা কেন হয়?

মেয়েদের হরমোনজনিত সমস্যার মূল কারণ হলো শরীরের অন্তঃস্রাবী (endocrine) গ্রন্থির অস্বাভাবিক কার্যকারিতা, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। বিভিন্ন কারণেই এ সমস্যা হতে পারে। নিচে কিছু কারণ তুলে ধরা হলো-

  • পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS)
  • থাইরয়েডের সমস্যা
  • প্রোল্যাকটিন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
  • মেনোপজ এবং প্রি-মেনোপজাল সিনড্রোম
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন
  • ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও ডায়াবেটিস
  • ওজন কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত ব্যায়াম
  • জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা অন্যান্য ওষুধের প্রভাব

সমাধান কী?

  • স্বাস্থ্যকর খাবার (প্রোটিন, সবজি, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট) খাওয়া  
  • নিয়মিত ব্যায়াম  
  • পর্যাপ্ত ঘুম ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট  
  • চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাইরয়েড ও PCOS পরীক্ষা করা  
  • কেমিক্যালযুক্ত প্রসাধনী কম ব্যবহার করা  

আপনার যদি নির্দিষ্ট কোনো হরমোনজনিত সমস্যা থাকে, তাহলে ডাক্তার দেখানো সবচেয়ে ভালো উপায়।

মেয়েদের হরমোনের সমস্যা বোঝার উপায়

হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যদি এই লক্ষণগুলো দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত থাকে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সাধারণত, মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় এমন কিছু হরমোনজনিত সমস্যার লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো—  

অনিয়মিত মাসিক চক্র-  পিরিয়ড সময়ের আগে বা পরে হওয়া, পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া।  
অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি বা হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া- হরমোনের অসামঞ্জস্যতা বিপাকক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।  
ব্রণ ও ত্বকের সমস্যা-  অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন বা অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বৃদ্ধির কারণে ব্রণ দেখা দিতে পারে।  
চুল পড়া বা অতিরিক্ত চুল গজানো-  মাথার চুল পড়ে যাওয়া বা মুখে ও শরীরের অপ্রয়োজনীয় স্থানে অতিরিক্ত চুল গজানো।  
অতিরিক্ত ক্লান্তি ও অবসাদ-  ঘুমানোর পরও সারাদিন ক্লান্ত অনুভব করা এবং মানসিক বিষণ্নতা।  
মেজাজের পরিবর্তন ও উদ্বেগ- উদ্বিগ্নতা, রাগ, দুশ্চিন্তা, এবং হতাশা।  
ঘুমের সমস্যা- ঘুম না আসা বা অতিরিক্ত ঘুমানো।  
প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা- গর্ভধারণে সমস্যা বা বারবার গর্ভপাত হওয়া।  

বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে সাধারণ হরমোনজনিত সমস্যা

বাংলাদেশের আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, এবং জীবনযাত্রার কারণে নারীদের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট হরমোনজনিত সমস্যা বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো—  

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) 
  - অনিয়মিত পিরিয়ড, মুখে বা শরীরে অতিরিক্ত চুল গজানো, ওজন বৃদ্ধি, গর্ভধারণে সমস্যা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।  
থাইরয়েডের সমস্যা (হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজম)
  - ওজন বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া, চুল পড়া, ত্বকের শুষ্কতা, অবসাদ ইত্যাদি।  
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও ডায়াবেটিস
  - অতিরিক্ত মিষ্টি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার ফলে ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।  
স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল বৃদ্ধি
  - অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে কর্টিসল হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হয়, যা ওজন বৃদ্ধি, উদ্বেগ এবং অনিদ্রা সৃষ্টি করতে পারে।  
মেনোপজ সংক্রান্ত সমস্যা
  - ৪৫-৫৫ বছর বয়সে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমতে শুরু করলে ঘাম হওয়া, মেজাজের পরিবর্তন, এবং হাড় দুর্বল হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।  

হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখার উপায়

হরমোনের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  

সঠিক খাবার বাছাই

খেতে হবে:

  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: ডিম, মাছ, মাংস, দই, বাদাম  
  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: ওটস, শাক-সবজি, ফল  
  • ভালো চর্বি: অলিভ অয়েল, নারকেল তেল, বাদাম  
  • প্রাকৃতিক প্রোবায়োটিক: দই, ঘোল  
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: টমেটো, গাজর, কাঁচা হলুদ, সবুজ চা  

যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে:

  • অতিরিক্ত চিনি ও মিষ্টি খাবার  
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার (ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংক)  
  • অতিরিক্ত ক্যাফেইন (চা, কফি)  
  • ট্রান্স ফ্যাট ও ভাজা-পোড়া খাবার  

স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ

ভালো অভ্যাস:

  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন: যোগ ব্যায়াম, হালকা ওজন তোলা, হাঁটাহাঁটি।  
  • মানসিক চাপ কমান: ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম।  
  • পর্যাপ্ত ঘুম নিন: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার।  
  • পানি পান করুন: দিনে অন্তত ২-৩ লিটার পানি পান করুন।  
  • অ্যালকোহল ও ধূমপান পরিহার করুন।

হরমোনজনিত সমস্যা প্রতিরোধের উপায়

  •  ডাক্তার দেখান: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং হরমোনের ভারসাম্য সংক্রান্ত কোনো সমস্যা থাকলে দ্রুত চিকিৎসা নিন।  
  • নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হন: অতিরিক্ত কাজ বা মানসিক চাপ শরীরের হরমোন ব্যাহত করতে পারে, তাই ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও বিশ্রামের জন্য সময় বের করুন।  
  • প্রাকৃতিক ও অর্গানিক খাবার গ্রহণ করুন: রাসায়নিকযুক্ত খাবারের পরিবর্তে পুষ্টিকর ও প্রাকৃতিক খাবার খান।  

নারীদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অনেক নারী হরমোনজনিত সমস্যার শিকার হন, তবে সচেতনতা এবং সঠিক জীবনযাত্রা অনুসরণ করলে এই সমস্যাগুলোর ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। সঠিক খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যমে হরমোনের সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।  

আপনার যদি উপরের লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটি দেখা দেয়, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং নিজের সুস্থতার দিকে মনোযোগ দিন!