ঢাকা বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

হার্ট অ্যাটাক: কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায়

লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২৫, ০৩:০১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা প্রায়শই স্বাস্থ্যকে অবহেলা করি। দৌড়ঝাঁপ, কাজের চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও অলস জীবনযাপনের ফলে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকিও দিন দিন বেড়ে চলছে আমাদের জীবনে।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির পরেও হার্ট অ্যাটাক (মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন) এখনো বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে হৃদপেশির কিছু অংশ অক্সিজেনের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

হার্ট অ্যাটাক যে কারো হতে পারে- বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি বেশি সাধারণ হলেও আজকাল তরুণদের মধ্যেও এর প্রবণতা বেশ বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার ফল হলেও, অনেক সময় বংশগত কারণেও এর ঝুঁকি থাকে। তবে সুখবর হলো, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আজকে আমরা হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ, লক্ষণ এবং কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপনার হৃদপিণ্ডের যত্ন নেওয়া এখনই জরুরি, কারণ একটি সুস্থ হৃদয়ই আপনার দীর্ঘ ও আনন্দময় জীবনের চাবিকাঠি।

হার্ট অ্যাটাকের কারণ

হার্ট অ্যাটাক সাধারণত করোনারি ধমনীতে (coronary arteries) রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মূলত হার্ট অ্যাটাক ঘটে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। নিচে কিছু কারণ তুলে ধরা হলো-  

  • করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD): এটি হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে সাধারণ কারণ। যখন ফ্যাটি প্লাক (plaque) ধমনীর প্রাচীরে জমে, তখন ধমনী সংকুচিত হয় এবং হৃদপিণ্ডে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।  
  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং ধমনীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।  
  • উচ্চ কোলেস্টেরল: অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রক্তনালীতে প্লাক তৈরি করে, যা হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয়।  
  • ডায়াবেটিস: উচ্চ রক্তশর্করা ধমনীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।  
  • অতিরিক্ত ওজন (স্থূলতা): অতিরিক্ত ওজন হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ও উচ্চ কোলেস্টেরলের সাথে সম্পর্কিত।  
  • ধূমপান: ধূমপান ধমনীগুলোর ক্ষতি করে, রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বাড়ায়।  
  • অতিরিক্ত মদ্যপান: অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন উচ্চ রক্তচাপ বাড়াতে পারে এবং হার্টের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।  
  • মানসিক চাপ ও অলস জীবনযাপন: অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও ব্যায়ামের অভাব উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে।  

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণসমূহ

হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণগুলো চেনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দ্রুত চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে পারে। প্রধান লক্ষণগুলো হলো: 

বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি: বুকের মাঝখানে চাপ, টানটান ভাব বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা কয়েক মিনিট ধরে থাকতে পারে।  
শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথা ছড়ানো: ব্যথা বাম হাত, গলা, চোয়াল, পিঠ বা পেটের দিকে ছড়িয়ে যেতে পারে।  
শ্বাসকষ্ট: বুকে ব্যথা ছাড়াও শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে।  
ঠান্ডা ঘাম: হঠাৎ করে ঠান্ডা ঘাম হওয়া এবং অস্থির অনুভব করা।  
বমি বমি ভাব বা বমি: অনেক সময় এটি অ্যাসিডিটির মতো মনে হতে পারে।  
অতিরিক্ত ক্লান্তি: বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।  
মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারানো: হঠাৎ করে মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে।  

যদি এই লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটি দেখা যায়, তবে দেরি না করে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেয়া জরুরি।  

হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের উপায়

যদিও বয়স ও জিনগত কারণ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তবে সুস্থ জীবনযাত্রা অনুসরণ করে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমানো যায়।  

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা
- বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল, সম্পূর্ণ শস্য, স্বাস্থ্যকর চর্বি (যেমন অলিভ অয়েল, বাদাম) গ্রহণ করুন।  
- সন্তৃপ্ত চর্বি, ট্রান্স ফ্যাট ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।  
- লবণ ও চিনি নিয়ন্ত্রণ করুন, যা উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোধে সহায়ক।  

নিয়মিত ব্যায়াম করা
- সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি মানের ব্যায়াম (যেমন হাঁটা, সাইক্লিং, সাঁতার) করুন।  
- পেশির শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম (যেমন যোগব্যায়াম, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ) অন্তর্ভুক্ত করুন।  

মানসিক চাপ কমানো
- মেডিটেশন, যোগব্যায়াম ও গভীর শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।  
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন।  

ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা
- ধূমপান ছেড়ে দিলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।  
- অ্যলকোহল পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত (নারীদের জন্য দিনে ১ গ্লাস, পুরুষদের জন্য ২ গ্লাস)।  

উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা 
- নিয়মিত রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করুন।  
- প্রয়োজন হলে ডাক্তার নির্দেশিত ওষুধ গ্রহণ করুন।  

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা
- স্বাস্থ্যকর বিএমআই (Body Mass Index) বজায় রাখার চেষ্টা করুন।  

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো
- ডাক্তার দেখিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।  

হৃদয়কে সুস্থ রাখতে খাবার 

হৃদয়কে সুস্থ রাখার জন্য সঠিক খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু হৃদয়-সুস্থ খাবারের তালিকা দেওয়া হলো:  

চর্বিযুক্ত মাছ (সালমন, ম্যাকেরেল, সার্ডিন, টুনা)
  - ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ, যা প্রদাহ কমায়, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায় এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে।  

শাক-সবজি (পালং শাক, কেল, সুইস চার্ড)
  - ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং ধমনীকে সুরক্ষিত রাখে।  

বেরি ফল (ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্ল্যাকবেরি)
  - অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফ্ল্যাভোনয়েডস সমৃদ্ধ, যা হৃদয়ের প্রদাহ কমায় এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করে।  

বাদাম (আলমন্ড, আখরোট, পিস্তা, কাজু, পেকান)
  - ভাল ফ্যাট, ফাইবার ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ, যা খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়।  

সম্পূর্ণ শস্য (ওটস, কুইনোয়া, ব্রাউন রাইস, গম)
  - ফাইবার সমৃদ্ধ, যা কোলেস্টেরল কমায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।  

অ্যাভোকাডো
  - মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।  

ডাল ও শিম (মসুর ডাল, ছোলা, কালো ছোলা, কিডনি বিনস)
  - উচ্চ ফাইবার, প্রোটিন ও খনিজ সমৃদ্ধ, যা কোলেস্টেরল ও প্রদাহ কমায়।  

ডার্ক চকলেট (৭০% বা তার বেশি কোকোযুক্ত)
  - ফ্ল্যাভোনয়েডস সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ কমায় এবং প্রদাহ প্রতিরোধ করে।  

অলিভ অয়েল (এক্সট্রা ভার্জিন)
  - মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা হৃদয় সুস্থ রাখে।  

রসুন
  - অ্যালিসিন নামক যৌগ সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমায়।  

বীজ (চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্সসিড, হেম্প সিড)
  - ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা হৃদয়কে সুরক্ষিত রাখে।  

গ্রিন টি
  - ক্যাটেচিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা রক্তনালী সুস্থ রাখে এবং কোলেস্টেরল কমায়।  

টমেটো
  - লাইকোপিন সমৃদ্ধ, যা ধমনীর প্লাক জমা প্রতিরোধ করে।  

সাইট্রাস ফল (কমলা, জাম্বুরা, লেবু, মালটা)
  - ভিটামিন C ও ফ্ল্যাভোনয়েডস সমৃদ্ধ, যা প্রদাহ কমায় এবং রক্ত চলাচল উন্নত করে।  

মিষ্টি আলু
  - ফাইবার, পটাশিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা হৃদয়কে সুরক্ষিত রাখে।  

হৃদয়-সুস্থ খাবারের জন্য অতিরিক্ত কিছু পরামর্শ:

  • প্রসেসড খাবার, ট্রান্স ফ্যাট ও অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে চলুন।
  • অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন, কারণ এটি উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে।
  • প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন ও শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন।  

হার্ট অ্যাটাক একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, তবে সঠিক জীবনযাপন মেনে চললে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। সুস্থ খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা হার্টের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারে। এছাড়াও, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ সম্পর্কে জানা ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা জীবন বাঁচাতে পারে। নিজের এবং পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জন্য এখন থেকেই হার্টের যত্ন নিন!

নিজের খেয়াল রাখুন, সুস্থ থাকুন!