মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫

টনসিল: গুরুত্ব-কার্যকারিতা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা

লাইফস্টাইল ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৫, ০২:৫০ পিএম

টনসিল: গুরুত্ব-কার্যকারিতা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা

ছবি: সংগৃহীত

টনসিল হলো আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার (ইমিউন সিস্টেম) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা গলার পেছনে অবস্থিত এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। এটি ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আটকে রেখে শরীরকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। তবে, কখনো কখনো টনসিল নিজেই সংক্রমিত হতে পারে, যার ফলে গলা ব্যথা, জ্বর এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।  

এই প্রবন্ধে, আমরা টনসিলের গুরুত্ব, এর কার্যকারিতা, এবং কীভাবে সঠিক জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করে টনসিলকে সুস্থ রাখা যায় তা আলোচনা করব।

টনসিলের তিনটি প্রধান ধরন রয়েছে। যথা-

প্যালাটাইন টনসিল– সবচেয়ে পরিচিত টনসিল, যা গলার দুই পাশে অবস্থিত।  
ফ্যারিঞ্জিয়াল টনসিল (অ্যাডেনয়েডস)– এটি নাকের পেছনে গলার ওপরের অংশে থাকে এবং বয়স বাড়ার সাথে ছোট হয়ে যায়।  
লিঙ্গুয়াল টনসিল– জিহ্বার পেছনের অংশে অবস্থিত, যা সংক্রমণ রোধে সহায়তা করে।  

টনসিল কেন গুরুত্বপূর্ণ?

টনসিল শরীরকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিকশিত হয়নি। এটি ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আটকে রাখে এবং এন্টিবডি ও শ্বেত রক্তকণিকা (white blood cells) তৈরি করে, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।  

তবে, টনসিল কখনো কখনো নিজেই সংক্রমিত হতে পারে, যাকে টনসিলাইটিস বলা হয়। এটি সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে হয় এবং নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে:  

  • গলা ব্যথা  

  • ফোলা টনসিল  

  • গিলতে সমস্যা  

  • জ্বর  

  • মুখে দুর্গন্ধ  

  • টনসিলে সাদা বা হলুদ দাগ  

টনসিলের কার্যকারিতা

টনসিল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিভিন্নভাবে সহায়তা করে:  

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি– এটি সংক্রমণ সনাক্ত করে এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।  
ক্ষতিকারক জীবাণুর বাধা– ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করা থেকে রোধ করে।  
ইমিউনিটি গঠনে সহায়তা– বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, টনসিল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।  

বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও উন্নত হয়, ফলে টনসিলের ভূমিকা কমে যায়। কিছু ক্ষেত্রে, যদি টনসিল বারবার সংক্রমিত হয় বা শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা সৃষ্টি করে, তবে ডাক্তার টনসিলেক্টমি (টনসিল অপসারণের সার্জারি) করার পরামর্শ দিতে পারেন।  

টনসিলকে সুস্থ রাখার উপায়

টনসিল সুস্থ রাখার জন্য এমন জীবনধারা অনুসরণ করা উচিত যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস উল্লেখ করা হলো:  

ভালো ওরাল হাইজিন বজায় রাখা 
- দিনে অন্তত দুইবার দাঁত ব্রাশ করুন এবং নিয়মিত ফ্লস করুন।  
- ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন।  
- খাবারের প্লেট, গ্লাস বা চামচ অন্যের সাথে ভাগাভাগি করবেন না।  

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা
গলা আর্দ্র রাখার জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি, যা টনসিলকে শুষ্ক হয়ে সংক্রমিত হওয়া থেকে রক্ষা করে।  

ধূমপান ও বায়ুদূষণ এড়ানো
ধূমপান ও দূষিত বায়ু টনসিলকে উত্তেজিত করতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করতে পারে, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।  

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা
শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি নিশ্চিত করতে:  

  • প্রতিদিন কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান।  

  • ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম বা শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে স্ট্রেস কমান।  

  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন।  

টনসিলের জন্য উপকারী খাবার

সঠিক খাদ্যাভ্যাস টনসিলকে সুস্থ রাখতে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। নিচে কিছু উপকারী খাবার দেওয়া হলো:  

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ভালো উৎস:  

  • কমলা  

  • লেবু  

  • স্ট্রবেরি  

  • ক্যাপসিকাম (বেল পেপার)  

প্রদাহ প্রতিরোধী খাবার
গলা ও টনসিলের ফোলা কমাতে সহায়ক:  

  • হলুদ– এতে থাকা কারকিউমিন প্রাকৃতিক প্রদাহবিরোধী উপাদান হিসেবে কাজ করে।  

  • আদা– গলার ব্যথা কমাতে ও সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।  

  • মধু– এতে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আছে এবং এটি গলাকে আরাম দেয়।  

প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার
প্রোবায়োটিক শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করে:  

  • দই  

  • কেফির  

  • কিমচি  

  • সৌরক্রাউট  

গরম পানীয়
গরম তরল খাবার গলাকে আর্দ্র রাখে এবং টনসিলের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। উদাহরণ:  

  • ক্যামোমিল টি  

  • গ্রিন টি  

  • মধু ও লেবুর গরম পানি  

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

যদি টনসিলের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর হয়, তবে ডাক্তার দেখানো জরুরি। নিচের উপসর্গ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন:  

  • বছরে ৫-৬ বার বা তার বেশি টনসিলাইটিস হলে।  

  • টনসিলের কারণে শ্বাস নিতে সমস্যা হলে।  

  • টনসিলে সাদা দাগ বা পুঁজ জমা হলে।  

  • টানা দুই সপ্তাহের বেশি গলা ব্যথা থাকলে।  

  • ঘুমের সময় শ্বাসকষ্ট বা অতিরিক্ত নাক ডাকার সমস্যা হলে।  

কিছু ক্ষেত্রে, যদি টনসিল সংক্রমণ বারবার হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সমস্যা সৃষ্টি করে, তবে ডাক্তার টনসিলেক্টমি (টনসিল অপসারণের সার্জারি) করার পরামর্শ দিতে পারেন। তবে, টনসিল অপসারণের পরও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে, কারণ শরীরের অন্যান্য অংশ এই দায়িত্ব পালন করে।  

টনসিল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পরিচ্ছন্নতা এবং শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বজায় রাখার মাধ্যমে টনসিলকে সুস্থ রাখা সম্ভব। যদি বারবার টনসিল সংক্রমণ হয় বা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।  

সুস্থ জীবনযাপন ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধ্যমে আপনি আপনার টনসিল এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারবেন।

আরবি/এসএস

Link copied!