ইলিশ কি শুধু একটুকরো মাছ? আমাদের জন্য ইলিশ তার চেয়েও অনেক বেশি। এটি বাঙালি জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পাশাপাশি, এটি সংস্কৃতি, আবেগ আর আত্মপরিচয়ের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। ভারতের ওড়িশা, বিহার, আসাম এই অঞ্চলগুলোতেও ইলিশ শুধু খাদ্য নয়, বরং বাংলা সংস্কৃতির এক তাৎপর্যপূর্ণ অনুষঙ্গ।
পহেলা বৈশাখ, জামাইষষ্ঠী কিংবা শারদীয় পূজায় ইলিশ ছাড়া যেন আয়োজনই পূর্ণ হয় না। ঘরে অতিথি এলে ইলিশ দিয়ে আপ্যায়ন করা মানেই সেই সম্পর্কের প্রতি এক বিশেষ সম্মান জানানো। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার প্রায় ৩০ কোটি মানুষ ইলিশ মাছ খেয়ে থাকে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিশ্বে স্যামন ও টুনার পরেই ইলিশের অবস্থান।
ইলিশের এই গ্রহণযোগ্যতা কেবল আধুনিক সময়েই গড়ে ওঠেনি। শত শত বছর ধরে এই মাছ আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। এই প্রিয় মাছটির নামেই গড়ে উঠেছে বহু এলাকা ও জনপদের পরিচয়। যেমন—যশোরের চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম ইলিশমারি। বলা হয়ে থাকে, একসময় কপোতাক্ষসহ আশপাশের নদী ছিল ইলিশে ভরপুর, ব্রিটিশ আমলেও সেখানে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত।
রাজবাড়ী থেকে মুর্শিদাবাদ—পদ্মার তীরবর্তী এলাকায়ও পাওয়া যায় ইলিশমারির চর কিংবা চর ইলিশমারি নামক স্থানের উল্লেখ, যেগুলো পদ্মার ভাঙনে হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। ভোলার ইলিশা নদী, ইলিশখালী খাল, কিংবা ঢাকা ও সুন্দরবনের ইলিশমারি নদী—এসব নাম প্রমাণ করে ইলিশ কেবল খাবার নয়, এটি এই অঞ্চলের ভূগোল, ইতিহাস আর সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।
দুঃখের বিষয়, আজ অনেক নদী যেমন হারিয়ে গেছে, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে সেই ইলিশভরা নদীর গল্পও। তবুও বাঙালির হৃদয়ে ইলিশের জায়গা অমলিন।

উপকারিতা
১. ইলিশে অন্যান্য মাছের তুলনায় স্যাচুরেট চর্বির পরিমাণ কম ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি (ইপিএ ও ডিএইচএ) অ্যাসিড বেশি থাকে, যা রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড কমিয়ে দ্রুত ভালো চর্বি বাড়াতে সাহায্য করে। এতে হৃৎপিণ্ড ভালো থাকে।
২. ইলিশের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের কারণে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। এতে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।
৩. ইলিশের ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বেশ ভালো কাজ করে। এ ছাড়া চর্বিসংক্রান্ত সব সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে।
৪. ইলিশের ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ৪০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। ইলিশে থাকা ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৫. ইলিশে এল-আরজিনিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে, যা মাংসপেশি ও টিস্যু তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৬. ইলিশে যে প্রোটিন থাকে, তা কোলাজেনসমৃদ্ধ। কোলাজেন হচ্ছে অদ্রবণীয় প্রোটিন, যা কোষের যোগাযোগক্ষমতা বাড়িয়ে কোষের সার্বিক কার্যকারিতা বাড়ায়। এ ছাড়া ইলিশে ভিটামিন সি থাকে, যা ত্বক সুস্থ রাখে। এর কোলাজেন ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
৭. ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় ইলিশ পেটের সমস্যা যেমন আলসার, কোলাইটিস ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে।
৮. মানুষের মস্তিষ্কের ৬০ ভাগই চর্বি (ফ্যাট) থাকে। ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। ওমেগা ৩ ছাড়াও ইলিশে আছে ভিটামিন বি১২, যা স্নায়ুকোষকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। স্মৃতিভ্রমের ঝুঁকি কমায়।
৯. ইলিশ ভিটামিন ডির ভালো উৎস। ভিটামিন ডি মানবদেহে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে।
১০. ইলিশে থাকা আয়োডিন, জিংক ও পটাশিয়ামের মতো বিভিন্ন খনিজ উপাদান রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে, কোষের সংক্রমণ কমাতে ও থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বহু গবেষণায় দেখা গেছে, সামুদ্রিক মাছ ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কার্যকর। শিশুদের ক্ষেত্রে হাঁপানি রোধ করতে পারে ইলিশ। যাঁরা নিয়মিত মাছ খান, তাঁদের ফুসফুস অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড অবসাদের মোকাবিলা করতে পারে। সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (এসএডি), পোস্ট–ন্যাটাল ডিপ্রেশন (সন্তান প্রস্রব–পরবর্তী বিষণ্নতা) কাটাতে সাহায্য করে ইলিশ মাছ।

সতর্কতা
ইলিশ খেলে কারও কারও শরীরে অ্যালার্জি বা গ্যাসের উদ্রেক হতে পারে। এ রকম সমস্যা থাকলে তাঁদের এ মাছ এড়িয়ে চলাই ভালো।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো ইলিশ
আমরা যে প্রজাতিটিকে পদ্মা ইলিশ বলি তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল টেনুয়ালোসা ইলিশ । এই ইলিশ বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে আমাদের নদী পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। এগুলি সকল ইলিশের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু - চর্বি এবং স্বাদে সমৃদ্ধ। দ্বিতীয় প্রকারটি চন্দনা ইলিশ নামে পরিচিত।
ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ
বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ, এরপর মিয়ানমার এবং তারপরে ভারত।
আপনার মতামত লিখুন :