ওয়ালটন ও মার্সেলের পণ্য বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ডিলাররা দোকান কর্মচারি আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশিসহ শতাধীক লোক (ভাড়া করে) নিয়ে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত লোকদের প্রশ্ন করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। স্বয়ং তাদের মধ্যে এ নিয়ে দেখা গেছে মিম্র প্রতিক্রিয়া।
মঙ্গলবার (১১ফেব্রুয়ারি) সকাল এগারোটার দিকে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ব্যানার নিয়ে শতাধীক লোক মানবন্ধনে দাঁড়ান। এতে বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। তাদের প্রশ্ন করা হয়, কেন মানববন্ধনে এসেছে, উত্তরে উপস্থিত শিমু-কিশোরা বলেন, জানিনা। আমাদের ৫০০টাকা দিয়েছে, তাই এসেছি। একইকথা বলেছেন মানববন্ধনে অংশ নেয়া আরও বেশ কয়েকজন। তারা কেউ জমিতে কৃষি কাজ করে আবার কেউ গাজীপুরের ভ্যান চালক।
এরআগে সোমবার গণমাধ্যমে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় ‘ক্ষতিগ্রস্থ ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ’ এর ব্যানারে। সেখানে ওয়ালটন ও মার্সেল ব্র্যান্ডের কোনো বিষয় তারা উল্লেখ করেনি। তবে আয়োজিত মানববন্ধনের ব্যানারের নিচে তারা ওয়ালটন ও মার্সেল ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করেছে।
মানববন্ধনে সরবরাহ করা লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ২০ লাখ পিস ফ্রিজ এর টার্গেট পূরণ করতে কোম্পানির প্রতিনিধীরা ব্যবসায়ীদেরকে না জানিয়ে তাদের কোটে পণ্য উত্তোলন করে অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স ব্যবসায়িদের নিকট বিক্রি করে এবং লেজারে সংযোজন করে।
এ কারনে ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।কোম্পানির ডিলারদের নিকট পণ্য বিক্রয় করতে পারলে উপরে উল্লেখিত কমিশন এরপর ৫ শতাংশ অতিরিক্ত কমিশন প্রদানের আশ্বাস দিলেও তা দেয়নি। এছাড়া ডিস্ট্রিবিউটরদের পাওনা টাকার সম্পূর্ণ না দিয়ে নিষ্পত্তির নামে জোর করে স্ট্যাম্প দিয়েয়ে টাকা বুঝিয়ে পাওয়ার স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে দাবি করে তাদের টাকা ফেরত দেওয়া দাবিও তুলেন।
৭ দিনের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সারা দেশের ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াল্টন ও মার্সেলের ব্র্যান্ডের ডিলাররা পরিবার ও দেশের সকল জনগণকে নিয়ে সাথে নিয়ে পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে বলেও ঘোষনা দেওয়া হয়।
তবে ওয়ালটন বলছে, কিছু লোক কোম্পানির বকেয়া পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যবসায়ী যারা না বুঝে ব্যবসায় নেমে ক্ষতিগ্রস্ত হযেছে তাদের সামনে এনে কোম্পানির টাকা আত্মসাত করার উদ্দেশ্যে কিছু ডিস্ট্রিবিউটরদের ভুল বুঝাচ্ছে।
কথা হয় নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে আসা ৬০ বছর বয়সী গিয়াস উদ্দিন এর সঙ্গে। মানববন্ধনে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, আমি কিছু জানি না, আবুলে আমাদের আনছে। আপনি কি ডিলার? কেন এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কেউ ডিলার না ডিলারের পক্ষ থেকে আমগরে আনছে, এখানে দাঁড়াইছি। আপনে ডিলারের সাথে কথা কন। এরপর মানববন্ধনের ব্যানার ছেলে চলে যান তিনি।
মানববন্ধনের আরেকটি ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আট বছর বয়সী ইয়াসিন। তিনি বলেন, আমি কাজ করি। কোথায় কাজ কর জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাইনসের বাড়িতে। তুমি কত টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছো?
পাশ থেকে দৌড়ে এসে ওয়ালটনের ডিলার আমির হোসেন বলেন, এটা আমাদের সন্তান, সেই হিসেবে আসছে। তার সামনেই বাবার নাম জিজ্ঞস করলে ইয়াসিন বলেন, জুতার কাজ করে। তখন লজ্জা পেয়ে স্থান ত্যাগ করেন ওয়ালটনের ডিলার আমির হোসেন।
আরেক পাশে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৯ বছরের হাবু মিয়া। তিনি কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছেন। তবে তিনি ওয়ালটনের কোনো ডিলার না বলে অকপটে শিকার করেন। তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জ খোলামোড়ে অটোরিকসা চালান। তার বন্ধু মিজানের সঙ্গে এখানে এসেছেন বলে জানান।
ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের দাবির বিষয়ে ওয়ালটন ডিস্ট্রিবিউটর নেটওয়ার্কের হেড অব সেলস ফিরোজ আলম বলেন, আমি দেশের প্রায় সব ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের চিনি, কিন্তু আজকে প্রেসক্লাবের সামনে যারা এসেছে তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর, বাকিদের আমি কোনদিন দেখি নি।
তিনি বলেন, কয়েকজন ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর ১৫-২০ দিন আগে আমাদের অফিসে আসছিলেন, এমডি স্যারের সাথে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন তাদের ক্ষতি হয়েছে। আমরা বলেছি যার যতটুকু ক্ষতি হয়েছে আপনারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে লিখতভাবে দেন।
আমরা অডিট করে যাচাই বাছাই করবো আসলেই আপনার ক্ষতি হয়েছে আমাদের কারণে কি না। তার পরেও আমরা সত্তিটা যাচাই করে দেখবো।
তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশে ওয়ালটনের হাজার হাজার শো রোম আছে, এখানে ব্যবসায়ী হিসেবে লাভ লস থাকে, কতিপয় লোক যদি ব্যবসা না বুঝে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি দেখতে হলে তো আমাদের লিখিত ভাবে দিতে হবে যে, আপনার পলিসির এই জায়গায় ভুল ছিল বলে আমার ক্ষতি হয়েছে, আজ পর্যন্ত তাদের কেউ কোন লিখিত কপি জমা দেয় নি। এ
মডি স্যার বলেছেন, আপনারা তো লিখিত দিয়ে আসতে হবে, না হলে আমরা কার ক্ষতিপূরণ দিব। সোমবার তাদের একজন নেতা বলেছেন তালিকা দিবে, আগে তালিকাটা দেন। তার পরে আমরা দেখি? কিন্তু কোন হিসাব ছাড়া আমরা কার কি দাবি মেনে নেব।
সোমবার তাদের এক নেতা বললো তালিকা দিবে সব দাবি মেনে নিতে। আমরা বললাম তালিকা বা আবেদন না পাওয়ার আগে সব দাবি মেনে নিলাম, এটা কি কেউ দিবে?
ফিরোজ আলম বলেন, কেউ যদি ব্যবসা করে দেউলিয়া হয়ে গেছেন এর যদি কোন পেপার্স থাকে আপনার কোন কোর্টের পেপার থাকে আমার টাকা দেয়ার সামর্থ নাই। তাহলে আমাদের সেই টাকাও আপনাদের দিতে হবে না।
তবে সেই পেপার্স তো আমাদের দিতে হবে। মৌখিক কথার কোন মুল্য নেই। কিছু লোক কোম্পানিকে নানান রকমভাবে চেক দিয়ে অতিরিক্ত বকেয়া না পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে কতিপয় অতিরিক্ত বকেয়ার লোকগুলো। ব্যবসায়ীকভাবে নলেজ না থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ডিস্ট্রিবিউটরদের সামনে এনে সুযোগ নিতে চাচ্ছে।
উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নামে-বেনামের সংগঠন ও অধিকার আন্দোলন দিয়ে চলছে সভা-সেমিনার আর মানববন্ধন। খালি চোখে এসবের পেছনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার ভাবে বুঝা না গেলেও মূলত ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করেই এসব আন্দোলন বা সভা সেমিনার হচ্ছে।
তাদের টার্গেটে পড়ে কেউ হচ্ছেন সর্বশান্ত আবার কোন কোন ব্যবসায়ী বা কোম্পানির সুনাম প্রশ্নের মুখে ফেলে আদায় হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। ‘অধিকার আদায়ের’ নামে বিভিন্ন ব্যানার ব্যবহার হচ্ছে হরদম। এ ধরণের ডজন খানেক প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
ক্ষতিগ্রস্থ ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ’, এমনই এক ভূঁইফোড় সংগঠন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি এই সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি চিঠি বিলি করা হয়। চিঠিতে বলা হয় ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন হবে।
তবে মজার বিষয় চিঠির তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি উল্লেখ থাকলেও, গণমাধ্যমগুলোতে পাঠানো হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। প্রেরকের ঠিকানা না থাকলেও, বাইপাল আশুলিয়া সাভারের ঠিকানায় নাম রয়েছে এই নামসর্বস্ব সংগঠনের।
পরে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন প্রেরকের সঙ্গে। তিনি জানান, তাকে ওপর থেকে যেভাবে বলা হয়েছে তিনি সেটিই করেছেন। প্রশ্ন করা হয়, আপনি চিঠির তারিখ উল্লেখ করেছেন ১০ ফেব্রুয়ারি, তাহলে ৮ ফেব্রুয়ারি অগ্রিম তারিখ দিয়ে কিভাবে স্বাক্ষর করলেন?
জবাবে জাহাঙ্গীর আলম রাজীব নামের এই চিঠি প্রেরক বলেন, তাকে যেভাবে বলা হয়েছে তিনি সেটিই করেছেন, আর কিছু জানেন না। যে সংগঠনের ব্যানারে চিঠি পাঠিয়েছেন, সেটির নিবন্ধন আছে? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন না নেই, তবে তাকে এই চিঠি পাঠানোর জন্য ঢাকা থেকে জনৈক এক ব্যক্তি পরামর্শ দিয়েছেন তাই তিনি স্বাক্ষর করে সেটি পাঠিয়েছেন।
এরআগে গত ১৩ জানুয়ারি একই ব্যানারে গণমাধ্যমে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। এতে জানানো ১৪ জানুয়ারি সকাল ১০টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
যথারীতি গণমাধ্যমকর্মীরা ডিআরইউতে উপস্থিত হয়। সেখানে গনমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত হয়ে জানতে পারেন সংবাদ সম্মেলন স্বগিত করা হয়েছে। এরপর সেখানে সংবাদ সম্মেলনের পরিবর্তে নিজেই মারামারিতে লিপ্ত হয়ে উঠেন। এমন একটি ভিডিও সেদিন গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। তবে এ বিষয়ে কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
শুধু একটি বা দু’টি নয়, জানা গেছে, এমন ডজন খানেক সংগঠনের খোঁজ পেয়েছে গোয়েন্দারা। তারা বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজির স্বার্থে এসব সংগঠনের নাম ব্যবহার করে থাকে।
জাহাঙ্গীর আলম রাজীব এর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি গত এক দশক ধরে সাভারের বাইপালে স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি বেক্সিমকো গ্রুপে কাজ করতেন। মূলত বেক্সিমকো গ্রুপের অর্থায়নে গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছেন যুবলীগের এই কর্মী।
বাইপালের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল চৌধুরী। ৫ আগষ্টের পর তিনি এখন অধিকার আন্দোলন নেতা বনে গেছেন। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে লোক জড়ো করে চাঁদাবাজির।
আপনার মতামত লিখুন :