সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ১২:৫০ এএম

পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়

ফাইল ছবি

একাত্তরের ১৪ মার্চ ছিল রোববার। অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তম দিন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতিকে ৩৫টি নির্দেশ দেন। 

বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৪ তারিখ এই ৩৫টি নির্দেশনা প্রকাশ করেন। পরদিন ১৫ মার্চ অধিকাংশ খবরের কাগজে এই নির্দেশাবলি ছাপা হয়।

এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের এই নির্দেশনার পর পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়।

প্রদত্ত নির্দেশে বলা হয়, বাংলাদেশের সর্বত্র কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেক্রেটারিয়েট ও দপ্তরসমূহ, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য আদালতে হরতাল বর্ণিত নির্দেশানুসারে পালিত হবে। 

বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ডিসি ও মহকুমা প্রশাসকগণ অফিস বন্ধ রেখে স্ব-স্ব এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে কাজ করবেন। প্রয়োজন হলে উন্নয়নমূলক কাজসহ অন্যান্য কাজও করবেন। 

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে সহযোগিতা করবেন। পুলিশ বিভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে, প্রয়োজনানুযায়ী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করবে।

এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামারুজ্জামান। 

আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। 

বাংলার জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যবদ্ধ মুক্তিপিপাসু গণমানুষকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ এদিন অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে সর্বসাধারণের উদ্দেশে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন।

বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ ঐক্যবদ্ধ আপামর জনগণ সামরিক আইনের কাছে নতি স্বীকার না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কাজেই যাদের প্রতি সামরিক আইনের সর্বশেষ আদেশ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, তারা যেন কোনো প্রকার হুমকির মুখে মাথা নত না করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের পেছনে রয়েছে।’ 

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তির আকাক্সক্ষা নির্মূল করা যাবে না। আমরা অজেয়। কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। প্রয়োজনবোধে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। 

কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুক্তির লক্ষ্যে পদার্পণ না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম আরও পূর্ণোদ্যমে অব্যাহত থাকবে। আমি যে কোনো আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকার এবং কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করলে তা সম্ভাব্য সব উপায়ে প্রতিরোধ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই।’

আগের দিনের জারি করা সামরিক ফরমানের প্রতিবাদে ঢাকায় মিছিল করেন প্রতিরক্ষা দপ্তরের বেসামরিক কর্মচারীরা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সম্পদ পাচার রোধের অংশ হিসেবে ঢাকার কয়েকটি স্থানে চেকপোস্ট বসায়।

চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ সারা শহরে মিছিল করে। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের এই মিছিল জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে সারা চট্টগ্রাম শহর। জাতীয় লীগের নেতা আতাউর রহমান খান অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বান জানান।

এদিকে ১৪ মার্চ করাচিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সমাবেশে এক পাকিস্তান ও দুই অঞ্চলে দুই দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে একটি ‘ফর্মুলা উদ্ভাবনের’ প্রস্তাব দেন।

আগের দিন জারি করা ইয়াহিয়া খানের সামরিক ফরমানের প্রতিবাদে ঢাকায় মিছিল করেন প্রতিরক্ষা দপ্তরের বেসামরিক কর্মচারীরা। সম্পদ পাচার রোধের অংশ হিসেবে ঢাকার কয়েকটি স্থানে চেকপোস্ট বসায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ সারা শহরে মিছিল করে। 

হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের এই মিছিল জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে সারা চট্টগ্রাম শহর। আর ঢাকার পত্রিকাগুলো একটি যৌথ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল- ‘আর সময় নেই’।

করাচির নিশতার পার্কে আয়োজিত এক জনসভায় বক্তৃতাকালে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি অনুযায়ী পার্লামেন্টের বাইরে সংবিধানসম্মত সমঝোতা ছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের পৃথকভাবে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে হস্তান্তর করা হোক।’ 

জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান খান অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বান জানান।

স্বাধীনতার মাস অগ্নিঝরা মার্চে দৈনিক ইত্তেফাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার মূল খবরের শিরোনাম ছিল, ‘উস্কানিমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করুন’। 

সামরিক কর্তৃপক্ষের নতুন নির্দেশের জবাবে ১৩ মার্চ সংবাদমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথা বলেন। তার কথায়, ‘সামরিক আইনের আর একটি আদেশ জারি হয়েছে জানতে পেরে আমি বিস্মিত হয়েছি। 

আমি যখন খোদ সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য ইতিমধ্যে বাংলার সমগ্র জনমানসের প্রচণ্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি, তখন নতুন করে এমন আদেশ জারি করা জনসাধারণকে উসকানিদানেরই শামিল। 

যারা এ ধরনের আদেশ জারি করছেন, তাদের এই সত্য উপলব্ধি করা উচিত যে, আজ জনসাধারণ তাদের ইস্পাতকঠিন সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না।’

সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি উসকানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘জনসাধারণকে ভীতি প্রদর্শনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কারণ তারা জানে, ঐক্যবদ্ধ মানুষের এই শক্তির বিরুদ্ধে কোনো কিছুরই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ নেই।’

মূল প্রতিবেদনে উঠে আসে, লাহোরে ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচটি পার্লামেন্টারি পার্টির নেতাদের সভায় দেশ থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে দেশের শাসনক্ষমতা হস্তান্তর এবং বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিবর্ষণের তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। 

সভায় যোগ দেন কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন লীগ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তানের নেতারা। 

সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্তারিত আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন এবং বর্তমান অচলাবস্থা দূরীকরণের পন্থা উদ্ভাবনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। 

ওয়ালীপন্থি ন্যাপ আগেই শেখ মুজিবুর রহমানের শর্তের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। ১৩ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও কাইয়ুমপন্থি মুসলিম লীগ ছাড়া পাকিস্তানের সব দলই বঙ্গবন্ধুর চার দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!