যেসব প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে জনগণ দুর্নীতিবাজ বলে ধারণা করে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেই সব সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এখন যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়, তাই কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হবে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন।
‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব জামিলা শবনম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও আওতাধীন দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে যাদের বিষয়ে জনমনে দুর্নীতিবাজ মর্মে ব্যাপক ধারণা রয়েছে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।’
জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সব সচিব এবং সরকারি দপ্তরের মহাপরিচালক, নির্বাহী পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের এক চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, যুগ্ম সচিব ও ওপরের পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে গত ৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি গঠন করে সরকার। জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির গত ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই নির্দেশনা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের চাকরি যাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। এমনও দেখা যায়, অনেকে চাকরি ছেড়ে গেছেন, পরে আবার আদালতের মাধ্যমে চার থেকে পাঁচ বছর আগের সব বেতনসহ ফেরত আসছেন। আমাদের এত এত অপচয়ের প্রজেক্ট হচ্ছে, ব্যর্থতার জন্য (ব্যতিক্রম দু-একটা ঘটনা ছাড়া) কারও কখনো কোনো শাস্তি হওয়ার তেমন কোনো নজির নেই।
তারা বলছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অপসারণের প্রক্রিয়া এতই ঝামেলার, এত এত দুর্নীতিতে কতজন অপসারিত হয়েছেন তা গুনে বলা যাবে। এটা এমন একটি মেশিন, যেখানে কেউ ঢুকলেন এবং তার বয়স না হওয়া পর্যন্ত সেই মেশিন চলতেই থাকল। এই সুযোগই অনেকে নিচ্ছে, ভবিষ্যতেও নেবে যত দিন এই চাকরি কর্মদক্ষতাভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক করা না হবে।
এই ক্ষেত্রে গত ২৫ বছরের ভারতের সরকারি চাকরি পরিবর্তন হয়েছে যে, এখন এই চাকরি অনেকটা হয়ে গেছে চুক্তিভিত্তিক, কাজ করলে তা নবায়ন করা হবে, না হলে বিদায়। বাংলাদেশেও এই সিস্টেম নিয়ে আসার মত দিয়েছেন অনেকে। কারণ ভারত পারলে আমরা পারব না কেন? এর ফলে সৎ কর্মচারীরা অনুপ্রাণিত হবেন, নিজের উত্তম ভবিষ্যতের জন্যই তারা কাজ করবেন, দেশ হবে গতিশীল।
জানা গেছে, শেষবার বেতন স্কেল দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, বেতন বাড়লে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বাংলাদেশ বরাবরই দুর্নীতিতে প্রথম দিকেই থেকে গেছি। এই সময়ের মধ্যে গণতন্ত্র হারিয়েছে এবং বাক্স্বাধীনতা কমেছে। ফলে সংবাদমাধ্যমেও দুর্নীতি নিয়ে আসা খবর কমে যায় বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
সংবাদকর্মীরা বলছেন, মাঝেমধ্যে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ হলেও তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ক্ষমতার আশপাশে থাকা সরকারি কর্মচারীদের সম্পত্তি বেড়েছে। তারা শুধু বিদেশেই সম্পদ গড়ছেন না, নিচ্ছেন দ্বৈত নাগরিকত্বও। কিন্তু ক্ষমতার পাশে থাকার কারণে তাদের সাত খুন মাফ।
তারা বলছেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে, সম্প্রতি কীভাবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নাম আসছে। দুজনের নাম মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে অনেক কিছু। সেখানে সিটিজেন জার্নালিজমের মাধ্যমেও আরও মানুষের দুর্নীতি প্রকাশ পাচ্ছে।
কিন্তু সরকার কী করেছে? দুর্নীতিবাজদের কি ধরতে পারছে তারা? আগেই বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে তাদের। বিদেশে চলে যাওয়ার পর বরং দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা আসছে।
বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ধুঁকছে টাকা পাচারের জন্য। আর ২০২১ সালে সরকার তদন্তে ২৮ পাচারকারীর নাম পায়। সে সময় একজন মন্ত্রীই বলেন, তাদের বেশির ভাগই সরকারি কর্মচারী। কিন্তু এত দিনে একজনও শাস্তি পাননি। এমনকি নাম প্রকাশও করা হয়নি। যদিও বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার প্রধান উপদেষ্টা থেকে সব কর্মচারীর সম্পদের হিসাব দিতে বলেছেন।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হলফনামা এবং প্রতি বছর সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এখন তা উধাও। যদিও হিসাব দিলেও কিছু হয় না। প্রতি বছর নির্বাচনের আগে এমপি প্রার্থীরা সম্পদের হিসাব দেন। সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রায় সবারই প্রকাশ্য আয় কয়েক শ শতাংশ বাড়ে। কোনো তদন্ত হয় না। তাই হিসাবের সঙ্গে তদন্তও বাধ্যতামূলক চান সুধীজনেরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এদিকে দুদক সরকারের অনুমতি ছাড়া তদন্ত করে না। ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার তথ্য প্রকাশের জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় পুলিশের কাছেও এ তথ্য আছে।
কিন্তু তারা এই তথ্য চেপে গিয়ে তথ্য প্রকাশকারীকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। হতে পারে সেই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, তাহলে আছাদুজ্জামান মিয়া কী করেছেন এই প্রশ্ন তাদের। সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদিক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকার কৌশল নিয়েছিল।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও বিশেষ বিবেচনায় চুক্তিভিৎিক নিয়োগ পাওয়া গভর্নরও বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। ফলে সাংবাদিকেরা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফ্লোরে যেতে পারছেন না।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সংগঠনটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিয়েছে।
এই বিষয়ে ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই বিষয়ে আমরা গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। আশা করি এই সমস্যার সমাধান হবে।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব জামিলা শবনম স্বাক্ষরিত চিঠিতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং আওতাধীন দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশের সংবিধানে এবং সরকারি চাকরি আইনেও কর্মকর্তা বলে কিছু নেই। তাপর পরও সরকারিভাবেই কর্মকর্তা বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(২) ধারায়, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ এ বিষয়ে টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক সুবাইল বিন আলম বলেছেন, আমরা সাধারণত চাকরিজীবীদের দুই ভাগে ভাগ করি, কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও সরকারি কর্মকর্তা বলে কিছু নেই, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং সরকারি চাকরি আইনেও কর্মকর্তা বলে কিছু নেই। আর আমরা সব ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে ওপরে ওঠাতে ওঠাতে আসলে কোথায় নিয়ে গেছি, তা এখনকার পত্রিকা দেখলেই বোঝা যায়।
জনগণের সেবক কথাটাই এখন হারিয়ে গেছে মানুষের মুখ থেকে, মন থেকেও। বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষের মনের মধ্যে ঔপনিবেশিক নতজানু ভাব এতটাই ঢুকে গেছে যে সবাই এই সুযোগ নেয়। এরপর বিভিন্ন খাতে দেওয়া আছে ইনডেমনিটি। দেশের বিশাল বিশাল ক্ষতি, তা থেকে প্রাপ্ত সুবিধা ও সরল মনের ভুল হিসেবে চালিয়ে যাওয়া। যেখানে জবাবদিহি থাকে না, সেখানে দুর্নীতি থাকবেই।
আপনার মতামত লিখুন :