ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪
আনসার আন্দোলন

সন্দেহে সাবেক ডিজি ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা

মেহ্দী আজাদ মাসুম

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৪, ০৮:৪৯ পিএম

সন্দেহে সাবেক ডিজি ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের সপ্তাহ না পেরোতেই রাজধানীতে শুরু হয় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষদের দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন।

কখনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কখনো নার্স-শিক্ষানবিশ নার্স, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, কখনো আবার আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী।

কয়েকদিনের ব্যবধানে রাজপথ ছেড়ে আন্দোলনের লক্ষবস্তু হয় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়।  আনসার বাহিনীর একাংশ অঙ্গীভূত সদস্যরা তাদের চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে রোববার (২৫ আগস্ট) সকাল থেকে রাত পর্যন্ত  প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে জিম্মি করে রেখেছিলেন সরকারের ৭ উপদেষ্টা, সিনিয়র সচিব, সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারিকে। ঘটনার এক পর্যায়ে ছাত্রদের ওপর হামলার পর ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যান এসব অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা।

প্রাথমিকভাবে দাবি মেনে নেয়া হলেও এ আন্দোলনে নামে অরাজকতার পেছনে অন্য কোন বিষয় আছে কী-না, তার অনুসন্ধান শুরু করেছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আনসারদের হঠাৎ করে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া এবং একদিনেই সব দাবি আদায় করে ঘরে ফেরার বিষয়টিতে সন্দেহ দানা বেধেছে। গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক এক মহা-পরিচালককে (সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদের কর্মকর্তা) ঘিরে। অভ্যুলত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে যওয়া সাবেক সরকারের মনোভাপন্ন এই মহা-পরিচালককে সম্প্রতি তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

সূত্র বলছে, সন্দেহ করা হচ্ছে তিনিই ছিলেন এই আনসার বাহিনীর আন্দোলনের নেপথ্যে। আর সামনে থেকে আন্দোলনের নেতত্ব দিয়েছেন মানিকগঞ্জের শিবালয়ের এক সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। 

আব্দুল কাদের নামের এই নেতা মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ষাটঘর তেওতা (বিলপাড়া) এলাকার ফজলুল হকের ছেলে। তিনি তেওতা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। কাদের বর্তমানে ঢাকার হযরত শাহ জালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনসারের পিসি হিসেবে কর্মরত।

সূত্র আরও জানায়, রোববার সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়া আনসারদের নেতৃত্ব দিয়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বক্তব্য দিতে দেখা যায় আব্দুল কাদেরকে। সচিবালয়ের ভেতরে বক্তব্য দেওয়া ওই ব্যক্তি যে আনসার সদস্য কাদের, তা স্থানীয় তেওতা ইউনিয়নের সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও প্রতিবেশী সফিউদ্দিন বিশ্বাস নিশ্চিত করেছেন।

সফিউদ্দিন বিশ্বাস রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কাদের দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সে আনসারে চাকরিও করছেন এবং ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ভিডিও দেখার পর নিশ্চিত হয়েছেন জানিয়ে সফিউদ্দিন আরও বলেন, ইউনিয়নে বিভিন্ন সময় ভিন্নমতের লোকজনদের নানাভাবে হয়রানিও করেছেন কাদের। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কাদের ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। সে আনসার বাহিনীতে চাকরি করেন। প্রায় ১০ বছর আগে আনসার বাহিনীতে চাকরিতে ঢুকেছে কাদের।

‘আব্দুল কাদের স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করেন কিনা’ জানতে চাইলে তিনি তার রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখার জন্য এ প্রতিবেদকের কাছে আকুতি জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উপজেলা নেতৃবৃন্দরা জানান, কাদেরের মতো আনসাররা ঘাপটি মেরে থেকে ষড়যন্ত্র করছিলো। তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। জিম্মি করে রেখেছিলেন পুলিশ র‌্যাব ও আনসার প্রধানদের। জিম্মি হয়ে পড়েন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কয়েকজন সমন্বয়কও। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠকে দেওয়া সিদ্ধান্তও প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনরতরা।

এদিকে, রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটু সময় দেয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘মাত্র দু’সপ্তাহ হয়েছে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমাদের একটু কাজ করতে সময় দিন। আমার বাসার সামনে বা সচিবালয়ের গেট বন্ধ করে নয়, আপনাদের দাবির বিষয়টি লিখিতভাবে আমাদের জানান, আমরা চেষ্টা করবো যৌক্তিক সমাধান দেয়ার।’ প্রধান উপদেষ্টার এ আহবানও প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনরত আনসারা।   

এইদিন রাত ১০টার পরে জিম্মিদশা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের উদ্ধারে আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের সড়কে এলে তাদের ওপর হামলা চালান আনসার সদস্যরা। এ ঘটনায় ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ছাড়াও শিক্ষার্থী-সাংবাদিকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাদের ওপরেও হামলা করেন আনসার সদস্যরা। এতে ছয় সেনাসদস্য আহত হন, যাদের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় সেনাবাহিনী। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। রাত ১১টা নাগাদ আন্দোলন মুক্ত হয় সচিবালয়ের আশপাশ। এরপর সচিবালয় থেকে একে একে বেরিয়ে আসেন সাত উপদেষ্টাসহ আটকে পড়া সব কর্মকর্তা। 

প্রসঙ্গত, চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে রোববার সকাল থেকে সচিবালয়ের সামনে প্রায় ১০ হাজার আনসার সদস্য অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে দুপুর ১২টা থেকে তারা সচিবালয় ঘেরাও করে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সাতজন উপদেষ্টাসহ সচিবালয়ের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। উত্তেজিত আনসার সদস্যদের শান্ত করার জন্য বিকেলে বাহিনীটির মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি সচিবালয়ে এসে আনসার সদস্যদের সব দাবি মেনে নেন। তবে দাবি মেনে নেওয়া হলেও অবরোধ চালিয়ে যান আনসার সদস্যরা। ফলে বিকেল ৫টায় অফিস ছুটি হলেও উপদেষ্টারাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আটকা পড়েন। এ সময় সচিবালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

আরবি/ এইচএম

Link copied!