ঢাকা: রাজনৈতিক মতের অমিল মানুষদের জন্য দেশ ছেড়ে পালানো সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ছিল গোপন বন্দিশালা। যা আয়নাঘর হিসেবেই পরিচিতি পায়। সেই আয়নাঘরে প্রায় সাড়ে ৫ বছর ছিলেন তৎকালীন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা। তার দুঃসহ জীবনের গল্প শেয়ার করেছেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। মাইকেল চাকমার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি মাইদুর রহমান রুবেল।
রূপালী বাংলাদেশ: মুক্ত দেশে আপনাকে স্বাগতম, এখন কেমন লাগছে?
মাইকেল চাকমা: আমার কাছে এখন সবকিছুই নতুন লাগছে। দমবন্ধ হওয়া জীবন থেকে মুক্তি মিলেছে, প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারছি। এখন ভালো লাগছে।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনাকে কেন কারাবন্দি করেছিল আর কেনইবা তুলে নিয়ে গেল?
মাইকেল চাকমা: ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে খাগড়াছড়িতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশকে কেন্দ্র করে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ। আমি ঢাকায় ছিলাম। যেহেতু সংগঠনটির মুখপাত্রের দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়ে, তাই আমি টার্গেটে পরিণত হই শেখ হাসিনা সরকারের। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাই আমার এক ব্যবসায়িক কাজে। যার সাথে কথা হয় সে রাজধানীর কল্যাণপুর আসতে বলে। আমি কল্যাণপুর আসার পর আর তাকে খুঁজে পাই না। বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপাশে একটি ব্যাংকের শোরুম আছে সেখানে যেতেই একজন বলল আপনাকে স্বাগতম। ভেতরে চলুন। ভেতরে যেতেই দেখলাম বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারী। আমি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলাম। মোবাইল বের করে ফোন করতে চাইলাম, দেখি ফোন কাজ করছে না। তারপর সাদা পোশাকধারী কয়েকজন আমাকে গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে যম টুপি পরিয়ে নিয়ে যায় শেখ হাসিনার গোপন বন্দিশালায়। যা আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত। আমাকে নিয়ে গাড়িটি চলে আনুমানিক আধঘণ্টা।
রূপালী বাংলাদেশ: ঘরটি কেমন, কি করা হয় সেখানে?
মাইকেল চাকমা: ঘরটির দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুটের বেশি হবে না। প্রস্থ ৮ থেকে দশ ফুট হবে। কোনো জানালা নেই। একটি লাইট মাথার উপরে সবসময় জ্বলত। ফ্যান একটি ছিল সেটি প্রচণ্ড শব্দ করত। এমনভাবে সেট করা সেটা দিয়ে গায়ে বাতাশ লাগত না। শব্দ দানব বলা চলে এটাকে। প্রচণ্ড কষ্ট দেওয়ার জন্য এটা লাগনো। দীর্ঘ পাঁচ বছর দিনের আলো দেখিনি। বন্দি থাকাকালে দরজার নিচ দিয়ে বা ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিছুটা আলো চোখে এসেছে। পরে অবশ্য অন্য একটি কক্ষে নিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে একপাশে জেলখানার মতো লোহার খাচা। বাকি তিন পাশেই দেয়াল। সেটা কবরের মতো। মনে হতো কবরে বসবাস করছি। ‘যেভাবে তারা রাখে এটা তো অত্যন্ত অমানবিক। এটা তো মানুষের বসবাসের জায়গা না। মানুষ এভাবে বাঁচে না। কবরের মতো। গুহা আছে না গুহা, গুহায় থাকলে মানুষ যেভাবে কিছুই দেখে না, কবরে থাকলে মানুষ যে কিছুই দেখে না ঠিক এই রকম।’ এটা তো মানুষের বাঁচার মতো কোনো জায়গা না। কোনো জানলা নাই। একদম কোনো আলো ঢোকে না, বাতাস ঢোকে না, শুধু চারদিকে দেয়াল। ‘কোনো কোনো রুম সাত ফিট বাই এগারো ফিট। কোনো রুম ছিল আট ফিট বাই এগারো বা বারো ফিট এ রকমের। মানে একদম ছোট ছোট রুম। ওখানে একটা খাট আছে তিন ফিট বাই সাত ফিটের লোহার। কোনো জায়গায় কাঠের।’
রূপালী বাংলাদেশ: আয়নাঘরে আর কারা ছিল, কারও সঙ্গে কথা হয়েছে?
মাইকেল চাকমা: দীর্ঘ সময়ে ঘুরেফিরে ৪-৫টি বন্দিশালায় আমাকে রাখা হয়। বন্দিশালায় আরও মানুষ আটক ছিলেন। পাঁচ বছরের বেশি সময় আমার আশপাশে আরও দুজনের নাম শুনেছি। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে, বিভিন্ন বয়সের লোক দেখেছি, তাদের কাউকেই আমি চিনি না। কারোর আমি দেখেছি চুল পাকা, দাড়ি পাকা। কেউ কম বয়সী। কোনো কোনো লোককে দেখেছিলাম তার বয়স হয়তো পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ হবে। কোনো কোনো লোক দেখেছি ষাটের ওপরে হবে। কেউ একদম ইয়াং। আমাকে যারা পাহাড়া দিত তারা চলে গেলে অত্যন্ত গোপনে কথা বলেছি। একজনের নাম সাইদুল, আরেকজন এরশাদ। সাইদুলের বাড়ি ছিল রংপুরে। এরশাদের বাড়ি ছিল ঢাকার কচুক্ষেতের কাছাকাছি সে বলেছে। সাইদুলকে যেদিন নিয়ে যায় আমি আমার বোনের নম্বর মুখস্ত করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম মোবাইল নম্বরের শেষের একটি ডিজিট আমি ভুল দিয়েছিলাম। তারা বেঁচে আছেন কি না জানি না।
রূপালী বাংলাদেশ: আয়নাঘরে মারধর করত কি না?
মাইকেল চাকমা: জাকির নামে একজন ছিলেন। তার সঙ্গে অন্য কক্ষের আটক বন্দির আরেকজনের কথোপকথন শুনে তাদের কোনো বাহিনীর সদস্য বলে মনে হয়েছে। ফিস ফিস করে বলত, স্যার আমি জাকির, আমি জাকির। আমার কাছে বারবার জানতে চেয়েছে শরিফকে তুমি চেন কি না। যিনি এক বলেছিল অপরজনের নাম শুনিনি তাকে স্যার ডাকত জাকির। জাকির তাকে বলেছে, আমাদের সম্ভবত কোর্ট মার্শাল হবে স্যার। জাকিরকে একবার বেদম পিটিয়েছে। মারধর করেছে। জাকির ওখান থেকে এসে বলছে, আমাকে আজকে অনেক মারধর করেছে স্যার। ওহ পারছি না। আমার জ্বর উঠেছে। মানে তারা কথাবার্তা বলত। তাকে ওষুধ দিত আমি শুনতাম। এটুকু আমি শুনেছি তাদের কথা।
রূপালী বাংলাদেশ: আর কাউকে দেখতে পেয়েছেন সেখানে?
মাইকেল চাকমা: গোপন কারাগারে কেউ কাউকে দেখার বা কথা বলার সুযোগ ছিল না। কক্ষগুলো একটু দূরে দূরে কিংবা মাঝখানের রুম ফাঁকা রাখত। তবে গোসল করতে নেওয়ার সময় বাথরুমের ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে কিছু বন্দি বিভিন্ন সময় দেখেছি। তখন বুঝেছি আরও অনেককে সেখানে রাখা হয়েছে।
রূপালী বাংলাদেশ: কি খেতে দিত সেখানে?
মাইকেল চাকমা: খাবারে বেশ কষ্ট দিত। লাউ, কুমড়া আর আলু। যখন মিষ্টি কুমড়া দিত ২-৩ মাস একই তরকারি। যখন লাউ দিত কমপক্ষে দুই মাস লাউ। আর আলু চলত টানা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট টুকরা মাছ পাওয়া যেত, সপ্তাতে ১ দিন মাংস দিত। এতটাই তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে যে, একপর্যায়ে সেখানকার সুপারভাইজরকে বলি আমাকে মেরে ফেলেন। এভাবে বাঁচা যায় না। আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয়। খাবার ও ঘুম নিয়ে প্রচণ্ড কষ্ট দিত। আমাকে একবার জিগ্যেস করল আপনি ঝাল খেতে পারেন। আমি শুধু বলেছি ঝাল খেলে আমার গ্যাসের সমস্যা হয়। তারপর এত ঝাল দিতে শুরু করল তরকারি আর মুখে দেওয়া যায়নি। ঝাল আর লবণের কারণে মুখে দেওয়া যেত না কোনো তরকারি। শুধু সাদা ভাত খেয়ে কাটিয়েছেন ১ বছর। শুধু ভাত কি খাওয়া যায়, মাঝে মাঝে মাংস ধুয়ে খেতাম। ধুয়ে খেলে ঝাল লাগত না কিন্তু লবণ ধুইলেও যেত না। অনেক কষ্ট হতো। আমার স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। ওজন কমে গেল।
রূপালী বাংলাদেশ: কখনো অসুস্থ হয়েছেন?
মাইকেল চাকমা: ২০২০ সালের শেষের দিকে একবার এমন জ্বর হলো মরে যাওয়ার অবস্থা। তখন ডাক্তার আনল। মাস্ক পরে রেইন কোর্টের মতো পোশাক পরে আমার নাকে-মুখে কাঠির মতো ডুকিয়ে দিল। তারপর আমার কাছে কেউ আসত না। দূর থেকে খাবার দিত। সকাল-বিকেল গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খেতে দিত। তখন বেশি বেশি খাবার দিত। কিছু ওষুধ দিত। বলত, বেশি করে খাবার খাও তবে সব ঠিক হয়ে যাবে। কি হয়েছে জানতে চাইলে বলত না। বের হয়ে শুনি করোনা বিশ্বে লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে গেছে। আমি জানিও না। এমন ভয়াবহ রোগের সাথে লড়াই করে বেঁচে ফিরেছি।
রূপালী বাংলাদেশ: পরিবারের লোকজন জানতে পেরেছিল কোথায় আছেন?
মাইকেল চাকমা: না, সেই সুযোগ পাইনি। পাশের সেলের একজনকে নাম্বার দিয়েছিলাম। পরে দেখি নাম্বারও ভুল ছিল। আমাকে অনেক খুঁজেছে পরিবার। আমার দল ইউপিডিএফ খুঁজেছে। তখন অনেক লোক গুম করে হাসিনা সরকার। অনেকদিন বাবাকে জানানো হয়নি আমি নিখোঁজ। নিখোঁজ থাকার প্রায় দেড় বছর পর জানতে পারে আমাকে পায় না। আমি গুম হয়ে গেছি। অসুস্থ বাবা আমার শোকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবাও মারা যায়। তিন বছর বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও যখন পায়নি, তখন আমি মারা গেছি ভেবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও সম্পন্ন করেছিল পরিবার। আমি জীবিত থাকলেও মরার মতোই ছিলাম। এখন নতুন জীবন পেয়েছি বলতে পারেন।
রূপালী বাংলাদেশ: অবশেষে আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেলেন কি করে?
মাইকেল চাকমা: গত ৬ আগস্ট শেষ রাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেন। চোখ বেঁধে জোর করে তোলেন গাড়িতে। জিগ্যেস করলাম অন্যসময় তো দিনের বেলা আমার রুম পরিবর্তন করতেন আজ রাতে কেন? কিছু বলে না তারা। ভেবেছিলেন কোথাও নিয়ে গিয়ে এবার হয়তো মেরে ফেলবে। রাতটিকে জীবনের অন্তিম সময় হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলাম। ভয় পেলেও মনে মনে ভেবেছিলাম এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। শেষ রাতে তাকে গাড়িতে নেওয়ার সময় কিছুটা আলগা করে চোখে কাপড় বাঁধা ছিল, যেটি একপর্যায়ে গাড়ির সিটে ঘসে ঘসে কিছুটা নামাতে সক্ষম হই। এবং আজানের পর কিছুটা আলোর দেখা পাই। অন্যসময় গাড়িতে এত লম্বা সময় চড়ায়নি। এবার ৫-৬ ঘণ্টা ধরে চলছে গাড়ি। মনে হচ্ছিল আমার এলাকা চট্টগ্রাম বা খাগড়াছড়ি নিয়ে মেরে ফেলবে। ছেড়ে দেবে একবারও ভাবিনি। যদিও সকালের আলো ফোটার আগেই চট্টগ্রামের একটি সড়কে অপ্রত্যাশিতভাবে নামিয়ে দিয়ে বলে এখানে শুয়ে পড়। তোমাকে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। আধঘণ্টা পর কাপড় খুলবে। এর আগে খোলার চেষ্টা করলে গুলি করে দেব। আমি তো আর ঘরি দেখতে পারছি না। অনেক সময় অপেক্ষার পর কামড়ে হাতে বাঁধা গামছা খুলতে পারি। তারপর চোখের গামছা খুলে দেখি কৃষিজমির পাশে রেখে গেছে। হেঁটে গিয়ে জানতে পারি, মিরেরসরাই এলাকায় ছেড়ে গেছে। মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারি, দুদিন আগে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। তখন বুঝতে পারি কেন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেড়ে নিল হাসিনা সরকার। আপনি কি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেবেন?
মাইকেল চাকমা: আমার জীবনের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর যারা শেষ করে দিয়েছে তাদের বিচার করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি এখনো অসুস্থ, সুস্থ ও স্বাভাবিক হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের কাছে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করব।
রূপালী বাংলাদেশ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাইকেল চাকমা: রূপালী বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ।
আপনার মতামত লিখুন :