ঢাকা শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪

বিমানবন্দরে প্রয়োজন দৃশ্যমান সেবা

কামরুল হাসান জনি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম

বিমানবন্দরে প্রয়োজন দৃশ্যমান সেবা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কয়েকবছর আগে আবুধাবিতে একটি অনুষ্ঠানে একজন বিজ্ঞ প্রবাসী বললেন- বাংলাদেশিরা অধিক আবেগপ্রবণ। তার এই কথার সত্যতা পেয়েছি বহু আগেই। বাংলাদেশিরা, বাঙালিরা যে পরিমাণের আবেগ লালন করেন তার সামান্য পরিমাণও দৃশ্যমান নেই আরবদের মাঝে। উদাহরণ না হয় অন্যসময় টানব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এখন ব্যক্তির আবেগ সহজে নির্ধারণ করা যায়। আবেগি বিষয়াদিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ার যে প্রবণতা; তাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে প্রবাসীদের আবেগের মাত্রা কেমন হতে পারে- এই প্রশ্ন আসার আগেই উত্তর মিলে যাবে। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-স্বজন ছেড়ে দূর দেশে বছরের পর বছর যারা অতিবাহিত করেন; তাদের আবেগ অন্যদের থেকে বেশিই থাকবে। তবে এদের শেষ লক্ষ্য একটাই- পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া। কারণ পরিবারই তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। দিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে তাই দু-চার মিনিটের জন্য হলেও প্রিয়জনের খোঁজ নিতে ভুল করেন না প্রবাসীরা। একটু আপদ-বিপদে এদের ঘুম হারাম হয়ে যায়।

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি উদাহরণ টেনে যদি বলি- দেশে যখন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো; তখন সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলেন প্রবাসীরা। প্রতি মুহূর্তে যারা খবরাখবরে থাকেন; তারাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারে ছিলেন। প্রিয়মুখ ও সন্তান-স্বজনের জন্য যে ব্যকুলতা তৈরি হয়েছে; তা কেবলই আবেগ-ভালোবাসার। দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এদের কেউ কেউ বিদেশের আইন ভঙ্গ করে রাস্তায়ও নেমে পড়েন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে কেউ কেউ শাস্তির মুখোমুখিও হন। যদিও পরে রাষ্ট্রীয় কৃপায় এদের অনেকে দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন। 

এবার মূল কথায় আসা যাক। গত সপ্তাহে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী কর্মীদের বিমানবন্দরে ভিআইপি সেবা প্রদানের পরিকল্পনার কথা জানান প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তার ভাষ্যমতে, এক মাসের মধ্যে বিমানবন্দরে এ সেবা চালু হবে। প্রথম ধাপে মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে আসা প্রবাসীরা এ সুবিধা পাবেন। লাউঞ্জ ও বিশেষ ইমিগ্রেশন ডেস্ক ছাড়া ভিআইপিদের বাকি সব সুবিধা পাবেন প্রবাসীরা। উপদেষ্টা জানালেন, দেশের ১২টি বেসরকারি ব্যাংক প্রবাসীদের ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের দুর্গম অঞ্চলের শাখায়ও প্রবাসী কল্যাণের বুথ থাকবে। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারবেন।

রেমিট্যান্স পাঠানো সহজতর করতে প্রবাসীরা টাকা পাঠালে মানি এক্সচেঞ্জ হাউসের সব খরচ ব্যাংকগুলো পরিশোধ করবে। এই বিষয়গুলো নিয়ে সপ্তাহজুড়ে কিছু প্রবাসীর মতামত জানতে চাওয়া হল। তারা কি আদতেই ‘ভিআইপি’ সেবা চান? মুখে মুখে ‘স্যার’ সম্ভোধন প্রত্যাশা করেন? প্রকৃতার্থে তাদের প্রত্যাশা আসলে কী? -যে জবাবগুলো এসেছে তা অত্যন্ত সাদামাটা। বিমানবন্দরে নেমে ‘স্যার’ ডাক শোনার আগ্রহ নেই ২ শতাংশেরও। ৯৮ শতাংশ প্রবাসীর প্রত্যাশাই দৃশ্যমান পরিবর্তন, সেবার মান বৃদ্ধি ও হয়রানি বন্ধ করা। বেশিরভাগ প্রবাসী গুরুত্ব দিয়েই বলছেন- বিদেশ যাত্রা ও দেশে অবকাশ যাপনে ফেরার পথ এবং মধ্যসময়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ড, প্রক্রিয়া ও খরচের বিষয়গুলোতে সরকারের বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে ফি মওকুফের বিষয়টিও জোরালোভাবে উঠে এসেছে সাধারণ প্রবাসীদের কণ্ঠে।

সহজ করে বলতে গেলে- প্রথমত শ্রমবাজারের জন্য নির্ধারিত দেশগুলোতে যেতে ইচ্ছুকদের অভিবাসন ব্যয় কমানো আহবান প্রবাসীদের। এরপরই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগের কথা এসেছে। কেননা, প্রবাসীদের যাতায়াতে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে উড়োজাহাজের ভাড়া পরিশোধে। আকাশচুম্বী টিকিট ব্যয় মেটাতে না পেরে বছরের পর বছর বহু প্রবাসীর দেশে আসাই হয় না। ইমিগ্রেশনে অযাচিত প্রশ্ন কিংবা হয়রানি বন্ধ, কাস্টমার সার্ভিস স্টাফ ও ইমিগ্রেশন স্টাফদের ভাল ব্যবহার, ব্যাগেজ রুলের নীতিমালা সংশোধনসহ সর্বোচ্চ প্রচার-প্রচারণা, প্রয়োজনীয় মালামালের ওপর শুল্ক কমানো, দ্রুত সময়ে লাগেজ প্রদান, বেল্টের পরিসর বৃদ্ধি, লাগেজ কাটা পুরোপুরি বন্ধ করা ও এর সঙ্গে জড়িতদের দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং এয়ারপোর্ট থেকে নিরাপদে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা প্রদান করা।

এই সেবাগুলোর দৃশ্যমান বস্তাবায়ন হলে ‘স্যার’ ডাকা কিংবা ‘ভিআইপি সেবার চেয়েও অধিক খুশি হবেন প্রবাসীরা। কেবল খুশীই নয় বরং বেশি উপকৃত হবেন তারা। রেমিট্যান্স প্রেরণ প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর বাড়াতে হবে। প্রথমত মানি এক্সেচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণের ফি মওকুফ বা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও এটি সরকার পরিকল্পনায় রেখেছে। তবে এটি বাস্তবায়ন হলে রাষ্ট্রই বেশি লাভবান হবে। হুন্ডি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ এবং জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অবৈধ অভিবাসীরা স্ব-স্ব দেশের আইডি কার্ড ছাড়াই কিভাবে বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রেরণ করবেন-তার একটি রাস্তা বের করতে হবে।

মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ এবং এই বিষয়ে সর্বোচ্চ সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। ছোট ছোট এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে সরকার এগিয়ে এলে এমনিতেই প্রবাসীরা সন্তুষ্টি জানাবেন। কেননা, দেশের বাইরে এখনও প্রায় ৭০ শতাংশ সাধারণ প্রবাসী। যাদের অধিকাংশই স্বল্প শিক্ষিত। এরা কাগজে কলমে সেবার চেয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ বা দৃশ্যমান কাজগুলোকে বেশি মূল্যায়ন করে থাকেন। সরকারকেও তাই তাদের প্রয়োজন বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেবল মুখে মুখে ‘ভিআইপি’ স্বীকৃতির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ; প্রবাসীদের জন্য দৃশ্যমান সেবা নিশ্চিত করা।

লেখক 

গণমাধ্যমকর্মী

সংযুক্ত আরব আমিরাত

আরবি/ আরএফ

Link copied!