ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
চট্টগ্রাম-পায়রা বন্দর থেকে

২০ হাজার কোটি টাকা লুট সোহায়েলের!

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৪, ১২:৪৩ এএম

২০ হাজার কোটি টাকা লুট সোহায়েলের!

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল সোহায়েল। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: দখল, লুটপাট, নিয়মবহির্ভূত ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক নৌবাহিনী থেকে সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। 

পায়রা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের চেয়ারম্যান থাকাকালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাথে যোগসাজশে অবৈধভাবে অর্জন করেন এই অর্থ। 

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট সহচর জেনারেল তারেক সিদ্দিকের ডানহাত হিসেবে পরিচিত এই সোয়াহেলের বিরুদ্ধে ২শ বিচারবহির্ভূত হত্যা, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা এবং তার দ্বারা সংঘটিত নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন বৈষম্যহীন দেশ গঠনে বিশ্বাসী সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাগণ।

অভিযোগে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল (বর্তমানে চাকরিচ্যুত হয়ে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে) দুই বন্দর থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। পায়রা বন্দরে ৮ হাজার কোটি এবং চট্টগ্রাম বন্দরে থাকাকালে ১২ হাজার কোটি টাকা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লুট করেছেন।

হেফাজতে ইসলামের ওপর কিলিং মিশন অপারেশন পরিচালনা, নৌবাহিনীর সব বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ, পরোক্ষ মদদে আওয়ামী লীগের অবৈধ নির্বাচনে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা, নিয়মবহির্ভূতভাবে আওয়ামী লীগের অধীনে প্রমোশন গ্রহণ, জেনারেল তারেক সিদ্দীকির ডানহাত হিসেবে অপকর্ম, দুই বন্দরের দায়িত্বকালে সীমাহীন দুর্নীতি, নানা উপায়ে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলা এবং তা বিদেশে পাচার, হুন্ডির ব্যবসা এবং মদদ দেওয়া, শেয়ারবাজার দুর্নীতি, নেশাদ্রব্য গ্রহণ এবং অসৎ চরিত্রের অধিকারী, বিকৃত রুচিবোধে জীবনযাপন, ধূর্ত ও পলিটিক্যাল লবিংকারী, এনআইডি পাসপোর্ট ও টিআইএনে মিথ্যা তথ্য প্রদান, সামরিক বাহিনীতে পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি ওপেনলি ব্যবহার করাসহ পারিবারিক জীবন নিয়ে কুকর্মের ফিরিস্তি দিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে। সেনাপ্রধানের দায়ের করা অভিযোগ জরুরিভিত্তিতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করা হয়েছে।

এদিকে একাধিক সূত্র জানায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ উপার্জনসহ সব অপকর্মই করেছেন নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। দখল, লুটপাট, বন্দরকেন্দ্রিক কমিশন বাণিজ্য, মামলার তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া সবই ছিল তার নেশা। এ ছাড়া র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ে থাকা অবস্থায় ২শ বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগও রয়েছে সোহায়েলের বিরুদ্ধে।

বাহিনীর সুনাম-মর্যাদার কথা তিনি কখনো ভাবেননি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুহাতে কামিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মো. আহসানুল্লাহ (অব.) বলেন, ৫ জন মানুষের নাম উল্লেখ করে কেস দেওয়া হলে তার সঙ্গে আরও ২-৩ হাজার নাম ঢুকিয়ে দিত বাণিজ্য করার জন্য।

সোহায়েলের ক্ষমতার দাপট দেশবাসী প্রথম দেখেছে যখন তিনি র‌্যাবের মুখপাত্র। পরে ডিজিএফআইয়ে যোগ দিয়ে হয়ে ওঠেন আরও ভয়ঙ্কর। ২০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সোহায়েলের বিরুদ্ধে। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও নিরীহ মানুষকে আটক করে অর্থ আদায়ের অভিযোগও বিস্তর। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্তের অভিযোগ আছে সোহায়েলের বিরুদ্ধে। এসব অপকর্ম করে দ্রুতই শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 

কোনো জাহাজ বা ঘাঁটি কমান্ড কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কোর্স না করেই পান একের পর এক পদোন্নতি। সাথে প্রাইস পোস্টিং। দেশ ছেড়ে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন কুকর্মের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী জেনারেল তারেক সিদ্দীকির ডানহাত হিসেবে পরিচিত সোয়াহেল। তারেকের নির্দেশমতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করত বলে জানা গেছে। পায়রা সমুদ্র বন্দরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর অর্থের নেশা আরও বেড়ে যায় সোহায়েলের। অভিযোগ রয়েছে, অনিয়ম আর লুটপাটের মাধ্যমে এখান থেকেই কামিয়েছেন প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এরপর সোহায়েলের সামনে আরও বড় সুযোগ আসে। 

রিয়ার এডমিরাল হয়ে ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাথে যোগসাজশে বন্দরকেন্দ্রিক সব ধরনের ব্যবসা, চুক্তি, ঠিকাদারি, নিলাম সবই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন সোহায়েল। অবৈধ কারবারিদের সহায়তায় কাস্টমসের কর্মকাণ্ডেও হস্তক্ষেপ করতেন তিনি। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অর্জন করেন ১২ হাজার কোটির বেশি টাকা। সোহায়েলের অর্জিত বেশিরভাগ অর্থই পাচার হয়ে গেছে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ আরও কয়েকটি দেশে রয়েছে তার সম্পদ। নিজ এলাকা ময়মনসিংহে বড় ভাই সাবেক যুগ্ম সচিব গোলাম কিবরিয়া ও আরেক ভাই শহিদের নামেও করেছেন বিস্তর সম্পদ। ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ২শ একর জমি দখল করেছেন সোহায়েলের পরিবারের সদস্যরা। যার মূল্য অন্তত ৪শ কোটি টাকা।

ময়মনসিংহ টিআইবি সভাপতি শরীফুজ্জামান পরাগ বলেন, যারাই দুর্নীতি করেছে এবং এদের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তাদেরকে অবশ্যই একটি যৌক্তিক বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।হাসিনার পতনের পর গত ১৯ আগস্ট বাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলকে। এরপর ২০ আগস্ট বনানী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে দ্বিতীয় দফায় গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে রিমান্ড রয়েছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের কাছে অপকর্মের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন সোয়াহেল। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে সোহায়েলের নামে ২০ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!