ঢাকা শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজানের দুর্নীতির ফিরিস্তি

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ০৪:৩৪ পিএম

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজানের দুর্নীতির ফিরিস্তি

ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের দুর্নীতির ফিরিস্তি বলে শেষ করা মুশকিল। পারিবারিক সিন্ডিকেট গড়ে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এই নেত্রী। একসময় সভা-সমাবেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা খুলনা-৩ (দৌলতপুর, খালিশপুর ও দিঘলিয়া (আংশিক)) আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ও পরিবারের সদস্যরা মিলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন।

প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তার ভাই, ভাতিজি, ভাগ্নেসহ পরিবারের ১৪ জনকে সরকারি চাকরি দিয়ে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ও কেন্দ্রীয় তহবিলের অর্থ নয়-ছয় করার অভিযোগ এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে।

সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান দায়িত্বে থাকাকালীন তার ভাই শাহাবুদ্দিনকে প্রথমে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (এপিএস), ভাতিজি শামীমা সুলতানা হৃদয় ও হৃদয়ের স্বামী মেহেরাব পাটোয়ারীকে কলকারখানা ও পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পদে চাকরি দেন। ভাগ্নে ইয়াসির আরাফাত পৃথিবীকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সহায়তায় গঠিত কেন্দ্রীয় তহবিলের সহকারী পরিচালক পদে চাকরি দেন। পরে প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজি, ভাতিজি জামাই ও ভাগ্নেকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এরপর তারা পুরো মন্ত্রণালয় নিজেদের কব্জায় নেন। গত ১৫ বছর তারা খুলনায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। ভাই, ভাতিজি, ভাতিজি জামাই ও ভাগ্নের নেতৃত্বে চক্রটি গড়ে ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে ঢাকা ও খুলনায় বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনসহ বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধান দল তদন্ত করছে।

প্রতিমন্ত্রীর পারিবারিক চক্রটি শ্রম মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান এবং খুলনার সরকারি সব ধরনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করত। ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি শামীমা সুলতানা হৃদয় ও ইয়াসির আরাফাত পৃথিবীর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সে সময় দুদকের অনুসন্ধান বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মো. শাহাবুদ্দিন দুদককে ম্যানেজ করার কথা বলে কলকারখানা ও পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের ঢাকা ও গাজীপুর অফিসের উপ-মহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন।

এদিকে, গত ১ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, তার ছোট ভাই এপিএস শাহাবুদ্দিন, ভাইয়ের মেয়ে শামীমা সুলতানা হৃদয়, ভাগ্নে ইয়াসির আরাফাত পৃথিবীর বিরুদ্ধে ফের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। গত সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, তার ভাই শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও ভাতিজি শামীমা সুলতানা হৃদয়ের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

আবেদনে বলা হয়, বিগত সরকারের প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনি এলাকার এমপিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অকল্পনীয় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন রয়েছে। অভিযোগসংশ্লিষ্ট সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠজন দেশ ছেড়ে বিদেশে পলায়ন করতে পারেন মর্মে অনুসন্ধানকালে বিশ^স্ত সূত্রে জানা যায়। অভিযোগ সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশগমনে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন। শুনানি শেষে আদালত তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

মন্নুজান সুফিয়া ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে খুলনা-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হন। গুঞ্জন রয়েছে, অপকর্ম-অনিয়মের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিট পাননি। দুদক সূত্রে জানা গেছে, মন্নুজান তার এপিএস ও ছোট ভাই শাহাবুদ্দিন, শাহাবুদ্দিনের মেয়ে শামীমা সুলতানা হৃদয়, বোনের ছেলে ইয়াছির আরাফাত পৃথিবী ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমসহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তারা শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে আত্মীয়স্বজনকে শ্রমিক দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা প্রদানের নামে লোপাট করেন।

মন্নুজান তার নিজ নামে ঢাকার উত্তরায় ১০ নম্বর সেক্টরে রাজউকের ৫ কাঠা জমি, খুলনার দৌলতপুরে তিনতলা বাড়ি, দুটি গাড়ি, কেডিএর মৌথুরী হাউজিংয়ে ১৬.০৭ কাঠা জমি কিনেছেন। বিভিন্ন নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির মাধ্যমে তার এপিএস ছোট ভাই শাহাবুদ্দিন, শাহাবুদ্দিনের মেয়ে হৃদয়, বোনের ছেলে পৃথিবী কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নামে-বেনামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফ্ল্যাট, প্লট ও ব্যাংক-ব্যালান্স গড়ে তুলেছেন।

আদালতে দেওয়া দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শ্রম প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এরপর অভিযোগসংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাঠানো হলেও অনুসন্ধানকাজ শেষ হয়নি। দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর সেটি বন্ধ রাখতে চেষ্টা-তদবির শুরু করেন মন্নুজানের এপিএস সাহাবুদ্দিন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় সফলও হন। ফলে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া অনুসন্ধান ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও শেষ হয়নি। দুদকের হাত থেকে বাঁচতে এপিএস শাহাবুদ্দিন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। তিনি দুদককে ম্যানেজ করতে ৪০ লাখ টাকা দিতে চান।

দুদককে ঘুষ দেওয়ার নামে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুরের অফিসের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহমেদ বেলাল ৩০ লাখ ও ঢাকার ডিআইজি এ কে এম সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে ১০ লাখ নেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে ৯৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়োগে বড় ধরনের বাণিজ্য হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর জেলা পর্যায়ের ডিআইজি-পরিদর্শক শ্রম অধিদপ্তরের সহকারী ও উপপরিচালকদের বদলি নিয়ন্ত্রণ করতেন ভাতিজি হৃদয়। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ছাড়া অন্য যেসব বাণিজ্যিক কোম্পানি রয়েছে, সেগুলো বছরে যে পরিমাণ লাভ করে, শ্রম আইন অনুযায়ী তার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করার নির্দেশনা আছে। এই ৫ শতাংশকে ১০০ ভাগ করে তার ১০ শতাংশ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা করতে হবে, যার ৮০ ভাগ সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়, সেখান থেকে একটি অংশ লোপাট করত এ এম ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট। তারা কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন।

শামীমা সুলতানা বর্তমানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলের উপপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) পদে কর্মরত রয়েছেন। সম্প্রতি তিনি কেন্দ্রীয় তহবিলের ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন। শামীমার পাশাপাশি তার আপন খালাতো ভাই এ এম ইয়াছিন ওরফে পৃথিবীর সম্পদের খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। ইয়াছিন একই মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলের সহকারী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব-প্রশাসন) পদে কর্মরত।

আরবি/ এইচএম

Link copied!