ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

শেখ হাসিনা’স ম্যান শফিউল আজিমের বিমান দুর্নীতি

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২৪, ১২:০৬ পিএম

শেখ হাসিনা’স ম্যান শফিউল আজিমের বিমান দুর্নীতি

ফাইল ছবি

বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দেশের এমন কোন খাত খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে দুর্নীতির কোন চিহ্ন ছিল না। মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি দপ্তর, শিক্ষা থেকে পরিবহন- সবক্ষেত্রেই যেন গড়ে উঠেছিল দুর্নীতির আখড়া। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই এসব অপকর্মের তথ্য এক এক করে বেরিয়ে আসছে। আর এবার সেই ধারাবাহিকতায় উঠে এসেছে বিমান বাংলাদেশের অপকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্য। যার নেতৃত্বে ছিলেন, তৎকালে দায়িত্বে থাকা বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শফিউল আজিম। বর্তমানে তিনি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন।

একাধিক গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পতিত হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতির আখড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজ, যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে সব রকম ক্রয়েই ছিল অনিয়ম। শুধু তাই নয়। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফ্লাইটে খাবার সরবরাহে অপকর্ম, নতুন সফটওয়্যার ক্রয়ে নিয়ম ভঙ্গ করার পাশাপাশি এসব কাণ্ডে জড়িতদের যথাবিচারের মুখোমুখি না করে বরং দায়মুক্তির নজিরও রয়েছে ভূরি ভূরি।

জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বিমানের খরচে বাড়তি সুবিধা দিতে গিয়ে অসংখ্যবার আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসায় বিমানের ডাক্তারকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় কোনো নিয়মনীতি না মেনেই। আর তৎকালে দায়িত্বে থাকা বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শফিউল আজিম এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন।

শফিউল আজিমের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অনেক অভিযোগ রয়েছে। বলা হচ্ছে, দোষীদের ছাড় ও অপকর্মে প্রশ্রয় দিতেন তিনি। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটাতেন। সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে ‘শেখ হাসিনাস ম্যান’ হিসেবে জাহির করতেন তিনি।

ইতোমধ্যেই ব্রুনাইয়ে থাকাকালে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর শফিউল আজিমের নির্যাতন চালানোর একটি ভিডিও ফুটেজও ফাঁস হয়েছে, যা একাধিক গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, ব্রুনাইয়ে কাউন্সিলর (শ্রম) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দূতাবাসের মধ্যে শ্রমিকদের লাথি ও লাঠিপেটা করছেন তিনি। এ বিষয়ে লিখিতভাবে আজিম জানান, ওই সময়ের ঘটনার ভিডিওটি খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলত তৎকালীন ব্রুনাইয়ে মানবপাচারকারী ও দালালচক্রের অত্যাচারে সাধারণ শ্রমিকরা অসহায় ছিলেন। অতিষ্ঠ শ্রমিকরা নিরুপায় হয়ে দূতাবাসের সাহায্য কামনা করতেন। ওই প্রভাবশালী দালালচক্র ক্ষিপ্ত হয়ে দূতাবাসে প্রবেশ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাদের গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিমানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. শাফিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কথিত আছে, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা পরিচয়ও শফিউলের প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল। যদিও এ বিষয়টি পুরোপুরি ভুল বলে দাবি করেছেন তিনি। অভিযোগ প্রসঙ্গে লিখিতভাবে শফিউল আজিম জানান, তিনি কখনোই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। নিজের পেশাদারত্ব ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বর্তমান অবস্থানে এসেছেন। তবে ‘শেখ হাসিনাস ম্যান’ প্রসঙ্গটি কৌশলে তিনি এড়িয়ে গেছেন।

শফিউল আজিমের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারেও আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়েও দেখা গেছে হাসিনার ছবি ও তার পাশে ‘শেখ হাসিনাস ম্যান’ স্লোগান। তাই তার অপকর্মের বিরুদ্ধে ওই সরকারের আমলে কেউ মুখ খোলার সাহস পর্যন্ত পেতেন না। ক্ষমতার পালাবদলের পর, এখন একে একে বেরিয়ে আসছে তার যত অপকর্ম; মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিমানের কর্মকর্তারা। বর্তমানে তিনি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন।

জানা গেছে, শফিউল আজিমের মুখে একটি সংলাপ প্রায়ই শোনা যেত- ‘ফেইলিউর ইজ নট অ্যান অপশন’। তার পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এটিই সত্যি। উন্নতির ধাপে ধাপে কখনও কোথাও ফেল করেননি তিনি, ছলে-বলে-কৌশলে ঠিকই এগিয়ে গেছেন। প্রশাসনের ১৫তম বিসিএস ব্যাচের এ কর্মকর্তা সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করে সচিব হন এবং দায়িত্ব পান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের। তার ব্যাচে তিনিই প্রথম এ পদে উন্নীত হন। তিনি যেখানে যখন দায়িত্বে ছিলেন, সেখানেই তার বিরুদ্ধে রয়েছে স্বজনপ্রীতি, প্রভাব বিস্তার ও অন্যায়ভাবে প্রশ্রয়দানের বিস্তর অভিযোগ। যদিও এসব অভিযোগ তিনি বরাবরই অস্বীকার করছেন।

সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সুবিধা দিতেই ব্যস্ত থাকতেন বিমানের তৎকালীন এমডি ও সিইউও শফিউল আজিম। ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি ও ১৬ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ১১ জুন সিঙ্গাপুরে নিয়মিত চিকিৎসার জন্য যান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কাদেরকে এক্ষেত্রে তিনবার অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে বিমান, সঙ্গে বিমানের পক্ষ থেকে একজন চিকিৎসকও দেওয়া হয়। যা আর্থিক অপচয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন।

কারণ কোনো যাত্রী বিমানে চড়ার পর যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন কিংবা কোনো যাত্রীর চিকিৎসক প্রয়োজন কিনা, সেটি বিবেচনা করবেন সংশ্লিষ্ট বিমান ক্রু। একে বলা হয় জেনারেল ডিক্লারেশন। কিন্তু কাদেরের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই মানা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কাদেরের সঙ্গে যাওয়ার সময় বিমান মেডিক্যাল সেন্টারের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আব্দুর রহমানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ দেখানো হয়েছে ফ্লাইটসংক্রান্ত নথিতে। ভিআইপি সফরসঙ্গীদের তালিকায় তার ঠিকানায় উল্লেখ আছে- সুকতাইল গোলাপাড়া, গোপালগঞ্জ; এনআইডি নম্বর : ১৯৯৩১০২২০০৪০০০১৩৪। অথচ এই এনআইডির ঠিকানা হচ্ছে- গ্রাম : চরসূত্রাপুর জহুরুল পাড়া, বগুড়া সদর। প্রভাবশালী মন্ত্রীর সফরসঙ্গীর এমন তথ্য গোপনের কাণ্ড রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্নেও অশনিসংকেত বটে।

এ অন্যায়ের সাফাই গাইতে গিয়ে তৎকালীন এমডি শফিউল আজিম গণমাধ্যমকে বলেন, অসুস্থ ভিআইপি যাত্রীদের ভ্রমণকালীন চিকিৎসক প্রেরণের বিষয়টি ম্যানুয়াল অনুযায়ী বিমানের স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক নির্ধারণ হয়ে থাকে। এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি তার দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানের টিকিট বিক্রিতে অনিয়মের খবর পুরনো। বিমানের সার্ভার হ্যাক, তথ্য চুরির মতো ঘটনা ঘটলেও ধামাচাপা দেওয়া হয় গত সরকারের আমলে। বিমান তা অস্বীকার করে তখন। অভিযোগ আছে টিকিটকাণ্ডে জড়িত বিপণন বিভাগের সংশ্লিষ্ট পরিচালকের অপকর্মেও শফিউল আজিমের নেপথ্য ইন্ধন ছিল।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বিমানের সাবেক এই এমডি গণমাধ্যমকে বলেন, টিকিট বুকিং সিস্টেম অটো জেনারেটেড হয় এবং যার নামে বুকিং হয়, তার পাসপোর্টের কপি দিতে হয়। বুকিংকালীন মোবাইল নম্বরে একটি ওয়াম টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) আসে। টিকিট সিস্টেম বিশ্বখ্যাত ‘সেবার’ সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে এমডির সুপারিশে টিকিট বুকিং রাখার সুযোগ নেই।

শুধু তাই নয়, শফিউল আজিমের সময়কালে বিমানের ফ্লাইটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে বাধ্য করা হয় কেবিন ক্রুদের। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডাও ঘটে। এ ছাড়া শোক দিবসের পাশাপাশি শিশু দিবস, শেখ কামাল দিবস, ফজিলাতুন্নেসা দিবস অর্থাৎ আওয়ামী সরকার গৃহীত যত দিবস, সেগুলো পালন করতে বাধ্য করা হতো বিমানকে। এতে অপারেশনাল কার্যক্রমের ব্যাঘাত ঘটলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। এ নিয়ে শফিউল আজিম তার বক্তব্যে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী এ নির্দেশনা জারি হয়েছিল। আর অপ্রচলিত দিবস পালনের বিষয়টি আদৌ সত্য নয়।

এছাড়া বিমান এমডি হিসাবে ১০ বছরের জন্য যুক্তরাজ্যের ভিসা নিয়েছেন শফিউল আজিম। অথচ এটি অনৈতিক। এত দীর্ঘ সময়ের জন্য তার ভিসা নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। এ বিষয়ে তিনি বলেন, লন্ডন কার্যালয় বিমানের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন। লন্ডন কার্যালয় নিজস্ব ভবন সংস্কার কার্যক্রম তদারকি ও বুঝে নেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে চুক্তি করতে জরুরিভিত্তিতে লন্ডন যাতায়াতের দাপ্তরিক প্রয়োজনে তিনি দীর্ঘমেয়াদি ভিসা নিয়েছিলেন।

সেই সঙ্গে বিমানের পোলট্রি কমপ্লেক্সে ১ কোটি টাকার লোকসান হয় ভুল ওষুধ ও খাবার প্রয়োগের কারণে। এটি বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্তে প্রমাণিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় ওই সময়ে। খবরে বেরিয়েছে- প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে। এরপর তৎকালীন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পরিবর্তন হয়। দায়িত্ব পান শফিউল আজিম। তার সময়েও ওই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

শফিউল আজিমের বিরুদ্ধে এত অভিযোগের পরও এখনও তিনি সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের দাবি, তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আরবি/এফআই

Link copied!