নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শিল্পী সম্মানীর বাজেট থেকে নামে-বেনামে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম টেলিভিশনের নির্বাহী প্রযোজক মো. সফির হোসাইনের (ইলন সফির) বিরুদ্ধে। দুদকের কাছে যাওয়া এসব তথ্য-প্রমাণ গায়েব করতে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রে পোস্টিং হওয়ার পরও তদবির করে বারবার চট্টগ্রামে ফিরে আসছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সদ্য শূন্য হওয়া প্রোগ্রাম ম্যানেজারের পদ বাগিয়ে নিতে বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির শুরু করেছেন ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সরকারের মদতপুষ্ট ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইলন সফির প্রোগ্রাম ম্যানেজারের দায়িত্ব নিতে পারলে তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সব প্রমাণ স্বহস্তে গায়েব করার আশঙ্কা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক জিএম মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে প্রায় ২১ কোটি টাকা দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা ও সংগীতশিল্পী সুজিত রায়, যা ৭ মার্চ ২০২৩ অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন দুদকের চেয়ারম্যান। অভিযোগে মাহফুজা আক্তারের দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে ইলন সফিরের কথা উল্লেখ করেন সুজিত রায়। মাহফুজা আক্তারের দুর্নীতির তদন্তকাজে তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করতে গিয়ে প্রায় কোটি টাকা দুর্নীতির সঙ্গে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের নির্বাহী প্রযোজক ইলন সফিরের সম্পৃক্ততা পায় বিটিভি চট্টগ্রাম কর্তৃপক্ষ। অনুষ্ঠান নির্মাণে নামে-বেনামে শিল্পী সম্মানীর চেক বানিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কর্মকর্তা না হয়েও এক মাসে ৪৭টি অনুষ্ঠানের বিপরীতে প্রায় ৩২ লাখ এবং প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমীনের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে ৬০ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৬ টাকার শিল্পী সম্মানীর বাজেট করেন ইলন সফির। প্রোগ্রাম ম্যানেজারকে পাশ কাটিয়ে এসব বাজেট এককভাবে অনুমোদন দেন মাহফুজা আক্তার। তাদের এই অপকর্মে সাড়া না দেওয়ায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমীনকে নানান অজুহাতে বিভিন্ন দফায় ৭৮টি শোকজ করেন জিএম মাহফুজা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, মাহফুজা আক্তারের দুর্নীতির সম্পৃক্ততায় তথ্য-প্রমাণ চেয়ে চলতি বছরের ৭ জুলাই বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার নুর আনোয়ার হোসেনের কাছে চিঠি পাঠান দুদকের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) নাঈমুল ইসলাম। একই চিঠিতে ইলন সফির অফিসবহির্ভূত অনুষ্ঠান প্রযোজনার তথ্যও চান তিনি।
দুর্নীতি দমনের কাছে বিটিভি চট্টগ্রামের দেওয়া তথ্য-প্রমাণের সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমীনের ছুটিকালীন বিভিন্ন সময়ে এবং উপস্থিত থাকাকালীন তাকে এড়িয়ে শতাধিক অনুষ্ঠানের জন্য ৬০ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৬ টাকার অনুষ্ঠান বাজেট অনুমোদন ও চেক সরবরাহ করা হয়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই সব বাজেটে স্বাক্ষর করেন নির্বাহী প্রযোজক ইলন সফির ও মাহফুজা আক্তার। প্রোগ্রাম ম্যানেজারের স্বাক্ষর ছাড়া শিল্পী সম্মানীর বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড় দেওয়া অস্বাভাবিক এবং অফিস আদেশ পরিপন্থি বলে দাবি করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর ইলন সফির প্রযোজক (গ্রেড-১) থেকে পদোন্নতি পেয়ে প্রযোজক হিসেবে পদায়ন হন। একই তারিখ পূর্বাহ্নে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে যোগদান করেন।
যোগদানপত্র প্রহণপূর্বক গত ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ অফিস আদেশ মোতাবেক ইলন সফিরকে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রে পদায়ন করা হলেও তিনি কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করে ১ মাস ১৩ দিন অনুপস্থিত থাকেন।
কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত এবং উল্লেখিত অসদাচরণের কারণে গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয় বিটিভি। কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় তাকে ‘অনুপস্থিত সময়ে’ বেতন কর্তনের লঘু শাস্তি প্রদান করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগ, পূর্বানুমোদন ছাড়া ছুটি ভোগ, দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং কর্মস্থলের শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বেশ কিছু কারণে চলতি বছরের ২৮ মে ইলন সফিরকে সতর্কতামূলক পত্র দেন বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার নুর আনোয়ার। এতেও কোনো কাজ না হলে গত ২৮ আগস্ট ইলন সফিরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে সদর দপ্তরে চিঠি পাঠান তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকাস্থ লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক গবেষণা সম্পাদক ইলন সফির রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করলেও তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, সাবেক জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে আঁতাত করে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী রাজনীতির প্রভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস পায়নি কেউ।
অভিযোগ রয়েছে, বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের অফিস আদেশ এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ইলন সফির তার পূর্ব কর্মস্থল বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে বিধিবহির্ভূতভাবে ৪৭টি অনুষ্ঠান নির্মাণের নামে শিল্পী সম্মানীর নামে-বেনামে চেক ইস্যু করে অর্থ আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে শতাধিক অনুষ্ঠান নির্মাণের বিপরীতে ১৯টি বিলের মাধ্যমে নামে-বেনামে ৬০ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৬ টাকার সম্মানী চেক ইস্যু করে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র। এসব বাজেটে প্রোগ্রাম ম্যানেজারের স্বাক্ষর থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রায় ৯৫ ভাগ বাজেটে প্রোগ্রাম ম্যানেজারের স্বাক্ষর ছিল না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
অভিযোগ রয়েছে, প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমীনের অনুপস্থিতিতে এসব বাজেটে স্বাক্ষর করেছেন নির্বাহী প্রযোজক ইলন সফির এবং জিএম মাহফুজা আক্তার। প্রোগ্রাম ম্যানেজারের স্বাক্ষর ছাড়া বিপুল পরিমাণ অর্থের বাজেট অনুমোদনের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করেন বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক জিএম নুর আনোয়ার হোসেন রন্জু।
এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে গত ২০ সেপ্টেম্বর ইলন সফিরকে তলব করে দুদক। তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা হিসেবে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমীন এবং সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নুর আনোয়ার হোসেন রন্জুকেও দুদকে তলব করা হয়।
দুদকে তলব এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দীর্ঘ সময় কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ইলন সফির। অস্বীকার করেন তার বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক চিঠি এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া অফিস আদেশের বিষয়েও। যখন তাকে নিশ্চিত করা হয় যে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে আপনার বেতন কর্তনের শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল এমন একটি অফিস আদেশ এই প্রতিবেদকের সংগ্রহে রয়েছে, তখন তিনি বলেন, ‘আমি এই আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছি।’ আপনি যদি অপরাধ না করে থাকেন, তাহলে পুনর্বিবেচনার আবেদন কেন করলেন এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমীনকে কল করা হলে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে আমার বদলি হয়ে গেছে, এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’
জানতে চাইলে সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নুর আনোয়ার হোসেন রন্জু বলেন, ‘সাবেক জিএম মাহফুজা আক্তার এবং নির্বাহী প্রযোজক ইলন সফিরের কিছু তথ্য চেয়েছিল দুদক এবং বিটিভি সদর দপ্তর। আমরা একটি কমিটির মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে তা দুদককে সরবরাহ করেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিভির অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) মো. রুহুল আমীন বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। কেউ যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মাহফুজা আক্তার ও ইলন সফিরের দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাব্যবস্থাপক (ডিজি) মাহবুবুল আলম মুঠোফোনে বলেন, ‘বিটিভিতে জয়েন করেছি মাত্র দুই মাস হলো। বিষয়গুলো আমার জানা নেই। অফিশিয়ালি যদি এ ধরনের কোনো অভিযোগ থাকে, সেটা খতিয়ে দেখব।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার ফোনকল দেওয়া হলেও কল রিসিভ করেননি বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার ইমাম হোসেন। মুঠোফোন রিসিভ করেননি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের (ঢাকা) উপসহকারী পরিচালক নাঈমুল ইসলাম।
আপনার মতামত লিখুন :