গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে টানা ১৫ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। রাজনৈতিক এমন পটপরিবর্তনের মধ্যেই বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন জটিলতার পাশাপাশি সম্মুখীন হতে হয় ভারতীয়দের অপতথ্যের প্রবাহেরও।
দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বাংলাদেশ নিয়ে অন্তত ১৪৮টি ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়। এর মধ্যে ভারতীয় ৭২টি গণমাধ্যম ৩২টি বিষয়ে মোট ১৩৭টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেগুলোতে বাংলাদেশকে নিয়ে ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসেও এই প্রবণতা নিয়মিত ঘটনা হিসেবে লক্ষ্য করছিল রিউমর স্ক্যানার। তবে পরের মাস অর্থাৎ আগস্টে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ নিয়ে ভারতীয়দের অপপ্রচার কয়েকগুণ বেড়ে যায়৷ প্রথম ছয় মাসে মাত্র ১২টি অপতথ্য ছড়ালেও আগস্টে এক মাসেই প্রচার হয়েছে ৫৩টি অপতথ্য।
পরের তিন মাস কিছুটা কমলেও ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার ইস্যুতে ভর করে ফের আগস্টের মতো একই সংখ্যক (৫৩) অপতথ্য প্রচার করেছে ভারতীয়রা।
ভারতীয়দের অপতথ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে পুরোপুরি মিথ্যা সম্বলিত ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ১০২টি। এছাড়া বিভ্রান্তিকর রেটিং দেয়া হয়েছে ৪২টি। বিকৃত রেটিং পেয়েছে চারটি।
অপতথ্যের প্রচারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া প্লাটফর্ম মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স (সাবেক টুইটার)। গেল বছর ১৪৮টি অপতথ্যের মধ্যে ১১৫টিই এক্সের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণ বলছে, এক্স ছাড়াও বাংলাদেশকে নিয়ে গত বছর ফেসবুকে ভারতীয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অর্ধশতাধিক অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। অপতথ্য প্রচারের তালিকায় আছে ইউটিউব এবং ইনস্টাগ্রামের নামও। এমনকি ভারতীয় গণমাধ্যমও অন্তত ৩২টি ঘটনায় অপতথ্য প্রচার করেছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর সরকারবিহীন পরের তিনদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। হামলা হয় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের বাড়ি এবং স্থাপনায়ও। এসব ঘটনাবলির মধ্যেই সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য এবং অপতথ্যের ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট ও সংবাদমাধ্যমে।
গত বছর ভারতীয়দের ছড়ানো যে ১৪৮টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার, তার মধ্যে ১১৫টিই সাম্প্রদায়িক অপতথ্য। গেল বছর সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের প্রচারের বড় এক মাধ্যম হয়ে ওঠে এক্স। আগস্ট মাসেই এক্সে ৫১টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানারের ইনভেস্টিগেশন ইউনিট ৫ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এক্সে এমন ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করেছিল, যেগুলোতে বাংলাদেশের আগস্টের ঘটনাবলির বিভিন্ন ছবি, ভিডিও এবং তথ্যকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হয়।
এসব অ্যাকাউন্টের প্রতিটির অন্তত একটি পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছিল রিউমর স্ক্যানার। এসব অ্যাকাউন্টে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে প্রচারিত উক্ত পোস্টগুলো দেড় কোটিরও বেশি বার দেখা হয়েছে।
আরও একাধিক অ্যাকাউন্ট এবং ভারতীয় গণমাধ্যমের বদৌলতে এসব অপতথ্য সে সময় ১০ থেকে ১২ গুণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল বলে অনুমান করে রিউমর স্ক্যানার।
আগস্ট পরবর্তী সময়েও এসব এক্স অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশকে নিয়ে ক্রমাগত অপতথ্যের প্রচার চালিয়ে গেছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার ইস্যুতে ডিসেম্বরে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের হার ফের বেড়ে যায় এক্সে। সে সময় এক্সে শনাক্ত হয় ৪১টি অপতথ্য। এই দুই মাসসহ গেল বছর এক্সে ভারতীয়দের ছড়ানো সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের সংখ্যা অন্তত ১০৭টি।
সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের এই ক্যাম্পেইনে ভারতীয় গণমাধ্যমও রেখেছে ভূমিকা। অন্তত ১০টি ঘটনায় ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এসব ঘটনায় এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, জি নিউজ, আজতক, রিপাবলিক বাংলা’র মতো মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার ২০২৪ সালে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত ভুল তথ্য নিয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণ করে ৩২টি ঘটনায় দেশটির ৭২টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে।
এই সংবাদমাধ্যমগুলোতে সর্বোচ্চ ১০টি থেকে সর্বনিম্ন একটি ভুল তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া গেছে। ৭২টি সংবাদমাধ্যমে থাকা ১৩৭টি প্রতিবেদন যাচাই করে ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে।
পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচারের দরুন প্রথম স্থানে রয়েছে ভারতের বাংলা ভাষার স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ‘রিপাবলিক বাংলা’। ৩২টি ঘটনার মধ্যে ১০টিতেই এই চ্যানেল ভুল তথ্য প্রচার করেছে।
এই তালিকায় পরের তিন অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে হিন্দুস্তান টাইমস, জি ২৪ ঘন্টা এবং আজতক। পঞ্চম অবস্থানে যৌথভাবে রয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, মিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, টিভি নাইন, ওয়ার্ল্ড উজ ওয়ান নিউজ (WION) এবং এই সময়।
গেল বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত থেকে একটি সমন্বিত বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা শুরু হয়, যা মূলত হিন্দুত্ববাদী এক্স অ্যাকাউন্টগুলোর দ্বারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণার মাধ্যমে গতিশীলতা লাভ করে।
এসব অ্যাকাউন্টগুলোর পাশাপাশি সে সময় থেকেই অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ভারতের গণমাধ্যমগুলোতেও অপতথ্যের প্রচার প্রসার লাভ করে। রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে এসব অপতথ্যের প্রচারের স্বতন্ত্র ধরণ লক্ষ্য করা গেছে। এই ধরণের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণটি হলো, কোনো একজন মুসলিম ঘটনাক্রমে হামলা বা নিগ্রহের শিকার হলে সেই ব্যক্তিকে হিন্দু দাবি করে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য সৃষ্টি করে প্রচার করা হয়েছে৷
২০২৪ সালে এমন অন্তত ৩৬টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। আরেকটি পরিচিত ধরণ হচ্ছে, ভিন্ন দেশ এমনকি ভারতেরই কোনো ঘটনাকে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া। এমন অন্তত ১৩টি ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
বাংলাদেশকে জড়িয়ে গেল বছর ভারত থেকে যেসব অপপ্রচার চালানো হয়েছে তাতে ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জড়ানো হয়েছে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। তাকে জড়িয়ে অন্তত চারটি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে দুইটি করে, অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন ও ছাত্রলীগ নেত্রী আতিকা বিনতে হোসাইনকে জড়িয়ে একটি করে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এর বাইরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে ছয়টি, বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে দুইটি, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে নিয়ে একটি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে দুইটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
অপতথ্যের শিকারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোও। ইসকনের বাংলাদেশ শাখা নিয়ে চারটি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে দুইটি এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিয়ে একটি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ভারতের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি গেল বছর বাংলাদেশকে নিয়ে অপতথ্যের প্রবাহের প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন। এই তালিকায় দেশটির রাজনীতিবিদদের মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী অন্তত একটি, বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল অন্তত তিনটি, ত্রিপুরা রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী কর্তৃক অন্তত একটি করে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন, ভারতীয় গণমাধ্যম অপি ইন্ডিয়ার সম্পাদক নুপুর শর্মাসহ আইনজীবী ও নানা পেশার ব্যক্তিত্বরা অপতথ্যের এই প্রবাহে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :