আওয়ামী লীগ নামে, আওয়ামী লীগ মতাদর্শে কোনো রাজনীতি করার সুযোগ নেই বলে দেশের স্বনামধন্য এক গণমাধ্যমকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
গণমাধ্যমটিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বর্তমান সময়ের আলোচিত প্রসঙ্গগুলো নিয়ে তিনি কথা বলেছেন।
তথ্য উপদেষ্টা বলেন, আমরা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছি। এক ধরণের বৈপ্লবিক পরিস্থিতি পার করছি। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে নজিরবিহীন। স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তা ছিল, অনিশ্চয়তা ছিল। সেদিক থেকে বলতে গেলে গত ছয় মাসে পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে, তবে গতিটা ধীর হচ্ছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল হয়তো আরও দ্রুত কিছু করতে পারবো। সর্বাত্মক চেষ্টার পরও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেটা পারিনি।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া, জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করার চ্যালেঞ্জ তো আছেই। দেখতেই পারছেন, সরকারের কলেবর ছোট হলেও কাজের পরিধি অনেক বেশি। জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে কাজ এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এরই মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিবেদন দিচ্ছে। জুলাই গণহত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। আমি মনে করি, অগ্রগতি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যদি আরও বেশি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে আরও বেশি গতিতে কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
নাহিদ ইসলাম বলেন, কিছু আক্ষেপের জায়গা রয়েছে, এটা ঠিক। গত ছয় মাসে প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রত্যাশিত মাত্রায় উন্নতি করতে পারিনি। তবে পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, অনিশ্চয়তা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে আসতে পারা।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে সরকার থাকবে কি থাকবে না, প্রতিবিপ্লব হবে কি না—এই ধরনের আলোচনা ছিল। দেশের ভেতরে ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, দেশের বাইরে ভূরাজনৈতিক নানা চাপ ছিল। আমাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারণা চালানো হয়েছে। দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নিয়ে টেনশন তৈরি করা হয়েছিল। তবে, এখন এসব টেনশন মোটামুটি দূর হয়েছে। আমি মনে করি, এটা বড় ধরনের অগ্রগতি।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা বলেন, পোশাক পরিবর্তন হলেই অনেক কিছু হয়ে যাবে, এমন কিছু আমরা ভাবছি না। তবে এর মধ্যে প্রতীকী বা সাইকোলজিক্যাল বিষয় আছে। কয়েকদিন আগে কয়েকজন শহীদের কবর জিয়ারত করতে গেলাম। আমার সঙ্গে থাকা পুলিশকে দেখে এক শহীদের স্বজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। অথচ ওই পুলিশ কিন্তু তার স্বজনকে মারেনি। একই পুলিশ যদি সাধারণ পোশাকে থাকতো, তাহলে ওই স্বজন ক্ষিপ্ত হতেন না। কারণ একটি বাহিনীর প্রথম পরিচয় পোশাকের মাধ্যমে। এটাই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সবার প্রত্যাশা, পুলিশ বাহিনী মানবাধিকার রক্ষা করে চলবে। অন্যদিকে পুলিশকে দাঙ্গা দমনে কাজ করতে হয়। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশের গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, নির্বাচন ও সংস্কারের মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই। বরং, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার জরুরি। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে নির্বাচন সঠিকভাবে হয়নি। নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। আন্দোলনের সময়ে বলেছি, আমার একটা নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যাতে ফ্যাসিজম ফিরে আসতে না পারে। ভবিষ্যতে কোনো সরকার যেন নির্বাচন ব্যবস্থাকে দলীয় বা ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে না পারে। এটা করা অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে, প্রাথমিকভাবে আমরা ভীতটা তৈরি করতে চাচ্ছি। রাজনৈতিক কমিটমেন্টটা নিতে চাচ্ছি, যাতে সামনের দিনে যারাই ক্ষমতায় আসবেন, তারা যেন সংস্কারের ধারাবাহিকতাটা রক্ষা করেন।
উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় রাখার জন্য গণঅভ্যুত্থানের পরপরই তরুণরা দল গঠন করেনি। তখন দল গঠন করলে অনেক বেশি মানুষ সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, এখনো হয়তো চান। তাই তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। সরকার অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। রাষ্ট্রপতি অপসারণের কথা উঠেছিল। তখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়েছি। তাই বিএনপির পক্ষ থেকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠানো যৌক্তিক হয়নি।
তিনি বলেন, `কিংস পার্টি`র আলাপটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। যারা `কিংস পার্টি`র আলাপ করছে, তারাই দেশের সবচেয়ে বড় `কিংস পার্টি`, বিএনপি। তারা ক্ষমতায় থেকে দল গঠন করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্ররা একক ক্ষমতাধর নয়। এখানে নানা ঘরনার লোকজন আছে। সরকার গঠনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশ নেওয়া হয়েছে। তাই এই সরকার বহুমুখী চরিত্র ধারণ করছে। নতুন দল গঠন হলে কী এই সরকারের সব উপদেষ্টা সেখানে যোগ দেবেন? তাহলে `কিংস পার্টি`র কথা কেন আসবে?
তিনি আরও বলেন,আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কী হবে না, বা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, এ বিষয়ে আমাদের একটা জাতীয় ঐক্যমতে আসতে হবে। আদালত, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য জায়গা থেকে এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা আসে সেটা সামনে বোঝা যাবে। তবে আমরা যারা অভ্যুত্থান করেছি, তারা মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই। আওয়ামী লীগের ব্যানারে, শেখ পরিবার বা চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও গণহত্যাকারীদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। আওয়ামী লীগ নামে, আওয়ামী লীগ মতাদর্শে কোনো রাজনীতি করার সুযোগ নেই। কারণ, তাদের মতাদর্শটা ফ্যাসিবাদী, যার ভিত্তিতে গত ১৫ বছরের রাজনীতি চলেছে, গণহত্যা হয়েছে। যারা ভুল বুঝতে পারবেন, তাদেরকে সেই আদর্শটাকে ত্যাগ করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের তো কোনো সমস্যা নেই। অন্য দলে যোগ দিতে পারেন, নতুন দল গঠন করতে পারেন।
নাহিদ বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। পুলিশকে ঠিকভাবে অ্যাকটিভ না করা গেলে নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে। অনেকে ভাবছে, নির্বাচন দিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বিষয়টা আসলে তা নয়। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি হওয়া প্রয়োজন। আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাই। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের নির্বাচনকে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন ধরা হয়। আমরা তার থেকেও ভালো একটি নির্বাচন উপহার দিতে চাই।
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানে সব দল-মতের লোকজন ছিলেন। অভ্যুত্থানের পর সবাই নিজ নিজ ব্যানারে রাজনীতি করছেন। এর বাইরে বিশালসংখ্যক ছাত্র-জনতা আছেন, যারা কোনো দলে নেই। তাদেরকে ধারণ করার মতো কোনো রাজনৈতিক ব্যানার এই মুহূর্তে নেই। সেই সংগঠনের কাজটিই ছাত্ররা করছে। তাদের মধ্যে নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা, রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। তারা তাদের নিজেদের মতো নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে পরিকল্পনা করছেন।
তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো চিহ্নিত বা গুরুত্বপূর্ণ নেতা সেখানে ছিলেন না। সাধারণ পর্যায়ের কিছু আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন। তবে তদন্তের কাজ চলছে। গুরুত্বপূর্ণ কেউ সেখানে ছিলেন কি না বা এখনো আছেন কি না, সেটার তদন্ত হচ্ছে। খুব সম্প্রতি এসএসএফের ডিজির মালিকানাধীন ফ্ল্যাট থেকে এক আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তারপরও সরকার তদন্ত করছে।
তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর একটি ভঙ্গুর অবস্থা আমরা পেয়েছি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সচিবরা পালিয়েছেন। এরপর বিভিন্ন বিষয়ে আমলাদের মধ্যে আন্দোলনের প্রবণতা ছিল। যেহেতু এখানে আলাদাভাবে কেউ দায়িত্বে নেই, তাই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
আপনার মতামত লিখুন :