ঢাকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে ঘুষ লেনদেন

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫, ০৭:২৪ পিএম

হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে ঘুষ লেনদেন

ফাইল ছবি

হত্যা, শেয়ার জালিয়াতিসহ একাধিক মামলা ধামাচাপা দিতে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একশ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান। এমনকি মামলা বন্ধের জন্য গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করেন সিমিন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি মামলার তদন্ত বন্ধ করে হত্যা ও শেয়ার প্রতারণা মামলায় তাকে আর গ্রেপ্তার করা হয়নি।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সিআইডির যৌথ তদন্তে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গণভবন থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র এবং শেখ হাসিনার পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধানে এসংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা। উল্লেখ্য, গণভবনে সিমিন রহমান শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য ৫০ কোটি টাকা, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের উন্নয়ন সংস্থা সূচনা ফাউন্ডেশনের জন্য ২৫ কোটি টাকা এবং নগদ আরো ২৫ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এই চেক প্রদানের সময় বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) এবং একাত্তর টেলিভিশনের তৎকালীন সিইও মোজাম্মেল বাবু উপস্থিত ছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সূচনা ফাউন্ডেশনের দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সূচনা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্ট নিরীক্ষা করে সেখানে সিমিন রহমানের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ২৫ কোটি টাকার চেক নগদায়নের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালের ১৮ মার্চ তারিখের চেকটি ২৭ মার্চ সূচনা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে নগদায়ন হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টেও একই সময়ে জমা হয় ৫০ কোটি টাকা। বাকি ২৫ কোটি টাকা নগদে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে শাযরেহ হক একই বছরের ২২ মার্চ গুলশান থানায় ভাইকে হত্যার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন। এই হত্যা মামলায় তিনি সিমিন রহমানকে প্রধান আসামি করেন। এ ছাড়া সিমিন রহমানের ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেনও ওই মামলার আসামি। এ ছাড়া ট্রান্সকম গ্রুপের এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।

এর পরই সিমিন রহমান সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ সময় একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল বাবুর সঙ্গে সিমিনের দুই দফা বৈঠক হয়। মূলত মোজাম্মেল বাবুই সিমিনকে গণভবনে নিয়ে যান।

গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতা গণভবনে প্রবেশ করে। সে সময় গণভবন থেকে যেসব দলিল-দস্তাবেজ উদ্ধার করা হয়েছিল তদন্তের স্বার্থে বর্তমানে সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেসব দলিল-দস্তাবেজে ২০২৪ সালে কারা কারা গণভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তাঁর মূল্যবান একটি তালিকা পাওয়া গেছে। ওই তালিকায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের ১৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় সিমিন রহমান গণভবনে প্রবেশ করেন। একই দিন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মো. সাইফুল আলম, একাত্তর টেলিভিশনের সিইও মোজাম্মেল বাবুও গণভবনে যান। গণভবনের এন্ট্রি লগে তাঁদের তিনজনের নাম পাশাপাশি পাওয়া গেছে।

সূত্র দাবি করেছে, সিমিন রহমানকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মোজাম্মেল বাবু। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মোজাম্মেল বাবু এই ব্যবস্থা করেন। ১৫ মার্চের ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ১৮ মার্চ। ওই দিনই সিমিন রহমান দুটি চেক এবং নগদ অর্থ নিয়ে গণভবনে প্রবেশ করেন। নগদ অর্থ ছিল বৈদেশিক মুদ্রায়। ডলার এবং ইউরো নিয়ে তিনি গণভবনে গিয়েছিলেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সিমিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত বছর ১৫ জুন রাতে। ওই বৈঠকে সিমিন প্রথম আলো বিক্রির জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও চুক্তিনামা শেখ হাসিনাকে দেখান ও অনুমতি নেন।

দ্বিতীয় বৈঠকে সিমিন রহমান শেখ হাসিনার কাছে দুটি চেক হস্তান্তর করেন। দুটি চেকই ছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের। একটি চেক ছিল বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য। ৫০ কোটি টাকার ওই চেকটি ট্রাস্টের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খানের (সাবেক সচিব) কাছে হস্তান্তর করেন শেখ হাসিনা। পরে তা নগদায়ন করা হয়। দ্বিতীয় চেকটি ছিল সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে। ২৫ কোটি টাকার ওই চেকটিও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের। ২৭ মার্চ ওই চেকটি নগদায়ন করা হয়েছিল সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এই চেকের সূত্র ধরেই সূচনা ফাউন্ডেশনের অবৈধ সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জানা গেছে, বাকি যে অর্থ দেওয়া হয়েছিল সেটি নগদে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা একটি হাতব্যাগে এই নগদ অর্থ গ্রহণ করেছিলেন।

উল্লেখ্য, এই তিন দফা বৈঠকে সিমিন রহমান তাঁকে হত্যা মামলা থেকে রেহাই দিতে শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করেন। বিনিময়ে তিনি এস আলমের কাছে প্রথম আলো বিক্রি করে দেওয়ারও অঙ্গীকার করেন। শেষ বৈঠকে এসংক্রান্ত একটি দলিলও চূড়ান্ত করা হয়। সেই সমঝোতা চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং একাত্তর টেলিভিশনের সিইও মোজাম্মেল বাবু স্বাক্ষর করেন। সিমিন রহমান শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন, প্রথম আলো বিক্রির পর তাঁকে যেন মামলাগুলো থেকে রেহাই দেওয়া হয়।

এর পরই ঘটতে থাকে নাটকীয় সব ঘটনা। রহস্যজনক কারণে আরশাদকে হত্যা মামলার তদন্ত স্থগিত হয়ে যায়। অথচ তাঁর আগে পুলিশ খুবই তৎপর ছিল। আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল। পোস্টমর্টেমও করা হয়েছিল নতুন করে। মামলা নিয়ে অনুসন্ধানের কাজও এগিয়েছিল অনেকখানি। কিন্তু উচ্চমহলের নির্দেশে হঠাৎ করে এই মামলার তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!