জনপ্রশাসন আর বিচার বিভাগে প্রতিষ্ঠানিক পরিবর্তন

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫, ০৮:১৬ এএম

জনপ্রশাসন আর বিচার বিভাগে প্রতিষ্ঠানিক পরিবর্তন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পুরোনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চার প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু, কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে নতুন দুটি বিভাগ, ‘নয়া দিল্লির মতো’ কেন্দ্রশাসিত রাজধানীতে মহানগর সরকার গঠন করে প্রশাসনিকব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস এবং ডিসির পদবি পরিবর্তন ও মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। অপরদিকে কোনো দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের যে এখতিয়ার রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ, রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় সদর দপ্তরগুলোতে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব ও মোবাইল কোর্টে কারাদণ্ড না দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। 

গতকাল দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রধান শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান। পরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদারসহ অন্যরা। সংস্কার কমিশন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে। সুপারিশে মন্ত্রণালয় ২৫টি ও অধিদপ্তর ৪৪টি করার প্রস্তাব রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৮ আগস্ট সরকার গঠন করার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য ৬টি কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ এবং সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে রিপোর্ট জমা দেয়। আর বাকি দুই সংস্কার কমিশন প্রধান প্রতিবেদন জমা দিল গতকাল।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের আলোচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে ‘জুলাই সনদ’ হবে, তার বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়। তিনি বলেন, জুলাই চার্টারের বাস্তবায়নের আলোকে নির্ভর করবে ইলেকশনটা কি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে হবে, নাকি আগামী বছর জুলাইয়ের মধ্যে হবে।

সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক কাতারে আনতে ঐকমত্য কমিশন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। আর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ। বাকি কমিশনগুলোর প্রধানরাও ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।

শফিকুল আলম বলেন, ছয়টা কমিশনের পুরো প্রতিবেদন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গে কথা বলবেন ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কথার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার আসলে দ্রুত করতে হবে, কতটুকু পরে করা যাবে। 

তিনি বলেন, কিছু সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনেরও প্রয়োজন পড়বে না, বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংস্কার সম্ভব হবে। আর কোনটা (সংস্কার) করার জন্য ‘কন্সটিটিউশনের এমেন্ডমেন্ট’ দরকার। আবার কিছু সংস্কারের জন্য একটা ইমেডিয়েটলি মিনিস্ট্রি করতে পারে, সেটার জন্য কন্সটিটিউশন রিফর্মের দরকার হয় না, এমনকি পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গেও সেভাবে কথা বলার প্রয়োজন নাও হতে পারে। কিন্তু উনারা সবার সঙ্গে কথা বলবেন।

বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন চেয়ে এলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা আগে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সারার ওপর জোর দিচ্ছেন।

বাংলাদেশকে চার প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ
ক্ষমতা ও পরিষেবাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করে ঢাকার ওপর চাপ কমাতে দেশের পুরোনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদনের নির্বাহী সারসংক্ষেপ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করা নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং সরকারের কার্যপরিধি সুবিস্তৃত হওয়ার ফলে বর্তমান প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামো যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয় না। 

অন্যদিকে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয় পর্যায়ে খুঁটিনাটি বহু কাজ সম্পাদন করা হয়। ক্ষমতার প্রত্যর্পণ (ডেলিগেশন) বিবেচনায় দেশে বিশাল জনসংখ্যার পরিষেবাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করার লক্ষ্যে দেশের পুরোনো চারটি বিভাগের সীমানা চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। ফলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ কমবে। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমবে।
জেলা পরিষদ বাতিল: কমিশন প্রতিবেদনে জানিয়েছে, স্থানীয় সরকারের একটি ধাপ হিসেবে জেলা পরিষদ বহাল থাকবে কি না সে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কখনোই নাগরিকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। কিছু জেলা পরিষদ বাদে অধিকাংশেরই নিজস্ব রাজস্বের শক্তিশালী উৎস নেই। 

নয়াদিল্লির মতো ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠনের সুপারিশ
ভারতের নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ (ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট) গঠনের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। 

কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে ভারতের নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যান্য প্রদেশের মতোই এখানে নির্বাচিত আইনসভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে। ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্টের আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিসেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনা করে নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সিটি নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ বা রাজধানী মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ করা হলো।

পৌরসভা শক্তিশালীকরণ: পৌরসভার গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানীয় সরকার হিসেবে একে অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন ওয়ার্ড মেম্বারদের ভোটে। কারণ, চেয়ারম্যান একবার নির্বাচিত হলে মেম্বারদের আর গুরুত্ব দেয় না।

উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা: স্থানীয় সরকার হিসেবে উপজেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তবে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদটি বাতিল করা যেতে পারে। উপজেলা পরিষদকে আরও জনপ্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশকে আবর্তন পদ্ধতিতে পরিষদের সদস্য হওয়ার বিধান করা যেতে পারে। 

উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উপজেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত না রেখে তাকে শুধু সংরক্ষিত বিষয় ও বিধিবদ্ধ বিষয়াদি যেমন আইনশৃঙ্খলা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ইত্যাদি দেখাশোনার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য তাকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখা। একজন সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার অফিসারকে উপজেলা পরিষদের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে বলে প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।

ভূমি ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় শ্রেণির একজন ভূমি ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কর্মরত কানুনগোদের মধ্যে থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অধীনে তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন করা যেতে পারে। এরূপ পদোন্নতির পরীক্ষা পিএসসির মাধ্যমে হতে হবে। পরে তারা পদোন্নতি পেয়ে ২৫ শতাংশ সহকারী কমিশনার (ভূমি) হতে পারবে।

ইউনিয়ন পরিষদের সংস্কার: ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে ৯-১১ করা যেতে পারে। প্রতিটি ওয়ার্ডে দুজন সদস্য নির্বাচিত হবেন, যাদের মধ্যে একজন অবশ্যই নারী হতে হবে বলে বিধান করার সুপারিশ দিয়েছে কমিশন। এর ফলে একদিকে নারীদের ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব এবং তাদের কর্ম এলাকা সুনিশ্চিত হবে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন মেম্বারদের ভোটে। কারণ, চেয়ারম্যান একবার নির্বাচিত হলে মেম্বারদের আর গুরুত্ব দেয় না বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে কমিশন। 

ইউনিয়ন পরিষদকে অধিক দায়িত্ব দেওয়া: কমিশন সুপারিশে জানিয়েছে, উপানুষ্ঠানিক ও মসজিদভিত্তিক উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদকে দেওয়া যেতে পারে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কৃষি ও পানিবিষয়ক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। একইভাবে পরিষেবাসংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা কমিটিসহ ও অন্য কমিটিগুলো গঠন করা যেতে পারে। 

ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে যে গ্রাম আদালত বা সালিশিব্যবস্থা রয়েছে তাকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা হলে গ্রাম পর্যায়ে মামলা-বিরোধ ইত্যাদি কমে আসবে। এলাকার জনসাধারণকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গণশুনানির মাধ্যমে এসব কমিটি গঠন করতে হবে এবং কমিটিগুলোর কার্যক্রমে তাদের উপস্থিত থাকার সুযোগ দিতে হবে বলে প্রস্তাব দিয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।

ডিসির পদবি পরিবর্তন ও মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিদ্যমান পদবি পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের নাম ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’ এবং ইউএনওর নাম পরিবর্তন করে ‘উপজেলা কমিশনার’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন: কমিশন উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কমিশন বলেছে, এটি করা হলে সাধারণ নাগরিকেরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এ বিষয়েও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেছে কমিশন। 

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ পদের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলেছে, থানার ‘অফিসার ইনচার্জ’ এর কাজ ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী পুলিশ সুপারকে ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ হিসেবে পদায়ন করা যেতে পারে।

বিসিএসে ‘ক্যাডার’ বাদ দিয়ে আলাদা নাম, নিয়োগ-পদোন্নতির জন্য তিন পিএসসি
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় বিদ্যমান একীভূত ‘ক্যাডার সার্ভিস’ বাতিল করে সার্ভিসের ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা নামকরণের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২৬টি ক্যাডারকে কমিয়ে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্ন ক্যাডার কর্মকর্তাকে এসব সার্ভিসে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে। 

প্রশাসনের কর্মকর্তারা থাকবেন মাঠে, সচিবালয় চলবে ‘এসইএসে’
বিদ্যমান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারকে ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস’ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই ক্যাডার সার্ভিসের পদগুলো মাঠ প্রশাসনেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর সচিবালয় চলবে সব সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’-এর কর্মকর্তাদের দিয়ে। এখানে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদের কর্মকর্তারা থাকবেন। ‘এসইএসে’ উপসচিব পদে প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য সার্ভিসের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখা হবে। 

১৫ বছর চাকরি করলে পেনশনসহ অবসর দেওয়ার প্রস্তাব: একজন সরকারি কর্মচারীর ১৫ বছর চাকরির পর পেনশন সুবিধাসহ অবসর নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এতে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী ১৫ বছর চাকরি করার পর সব সুবিধাসহ অবসর নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। এটি কর্মজীবন পরিবর্তনের জন্য বেছে নেওয়া কর্মকর্তাদের জন্য চাকরি থেকে চলে যাওয়ার সুবিধা দেবে। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা ২৫ বছর চাকরি করার পর অবসরে গেলে পেনশনসহ সব অবসর সুবিধা পেয়ে থাকেন।

প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ
প্রতিবেদনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধি করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এতে বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেশের মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রদত্ত ইনডেক্স বিশ্লেষণ করে মূল বেতন প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তবে তা ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। 

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে উপসচিবদের গাড়ি কেনা ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ সুযোগ সচিবালয়ের বাইরে অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জন্য নেই। এ ব্যবস্থা বাতিল করার সুপারিশ করা হলো। এতে বৈষম্য দূর হবে এবং সরকারের ব্যয় কমবে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব
কোনো দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের যে এখতিয়ার রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। মোট ২৮ দফা প্রস্তাবের ছয় নম্বরে রয়েছে ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন’সংক্রান্ত অংশটি। এতে বলা হয়েছে, আদালত কর্তৃক চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বোর্ড প্রতিষ্ঠা, যার সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। 

সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে ‘ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার’ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়ার ঘটনা আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হওয়ার নজির রয়েছে।

বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চের সুপারিশ
রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় সদর দপ্তরগুলোতে স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন। একইসঙ্গে উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালত সম্প্রসারণ এবং বিভাগীয় পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত স্থাপনেরও সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। বাংলাদেশে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের জুনে সংবিধান সংশোধন করে বিভিন্ন বিভাগে হাইকোর্টের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। 

সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য পাল্টে যাবে এমন যুক্তিসহ নানা কারণ দেখিয়ে সে সময় ঢাকায় আইনজীবীরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। হাইকোর্টে ওই গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটও হয়। পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ অষ্টম সংশোধনীর বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের অংশটুকু অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।

মোবাইল কোর্টে কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না
মোবাইল কোর্টের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ সংঘটিত হওয়ার স্থানেই দ্রুততার সঙ্গে তার প্রতিকার করতে সক্ষম হন। এভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তির উদাহরণ সৃষ্টি হওয়া একই ধরনের অপরাধের প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। 

মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়িয়ে স্বল্পসময়ে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। ফলে জনগণের কাছে তা আইন প্রয়োগ সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে সহায়তা করে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট আইনের সাংবিধানিকতা বিষয়ে আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলায় বিষয়টির চূড়ান্ত মীমাংসা হবে। এরই মধ্যে বাস্তবতার নিরিখে মোবাইল কোর্টের প্রয়োজনীয়তা এবং এর সমান্তরালে মোবাইল কোর্ট আইনের সাংবিধানিক ও আইনগত অসংগতিগুলোর বিবেচনায়, সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে। 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!