হাজারো তাজা প্রাণের বিনিময়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশে ভাত, ভোট, আইন, নিরাপত্তাসহ মানুষের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে। চাকরিতে প্রবেশের যে ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈষম্য কতটা দূর হয়েছে। ছাত্রদের নতুন দলের মিশন ও ভিশন কী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কি নির্বাচন বিলম্বে হওয়ার পক্ষে।
সাম্প্রতিক নানা বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ কথা বলেছেন, রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক- এফ এ শাহেদ এবং মোতাহার হোসেন।
রূপালী বাংলাদেশ: নিশ্চিত মৃত্যু উপেক্ষা করে কোন শক্তি ও চেতনায় জুলাই অভ্যুত্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্র-জনতা?
হাসনাত আবদুল্লাহ: দেড় দশকের বেশি সময় ধরে এ দেশে মানুষ তাদের তাদের স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা, ভোটের অধিকার থেকে শুরু করে ন্যূনতম সব মৌল-মানবিক, সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। একই সঙ্গে বিচারবহির্ভূত ঘুম-খুন, হত্যা, চাঁদাবাজির যে ঘটনা ঘটেছিল, তাতে মানুষের ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষোভই শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে দেশের সব স্তরের মানুষ নিশ্চিত মৃত্যু উপেক্ষা করে অধিকার আদায় ও বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
রূপালী বাংলাদেশ: ছাত্রদের নতুন যে রাজনৈতিক দল আসছে, তাদের মিশন-ভিশন কী হবে?
হাসনাত আবদুল্লাহ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এরই মধ্যেই মানুষের কাছে যাচ্ছে তাদের মতামত গ্রহণ করছে, কেমন বাংলাদেশ চাই, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষই নির্ধারণ করবে কেমন রাজনৈতিক দল চান তারা। দেশে অতীতের যে রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে তাদের যে কাঠামো, নীতি, আদর্শ মেনডেড তা দল থেকে নির্ধারণ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু, আমাদের যে রাজনৈতিক দল তার কার্যক্রম, মেনডেড, মিশন-ভিশন কী হবে তা জনগণই ঠিক করবে।
রূপালী বাংলাদেশ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কি সরকারের অংশ?
হাসনাত আবদুল্লাহ: স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা সরকারের অংশ না। গণঅভ্যুত্থানের যে তিনজন প্রতিনিধি সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন তারা দেশের সবার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। একইসঙ্গে, উপদেষ্টামণ্ডলীতে যেসব ব্যক্তি রয়েছেন, তারা সব ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সেই জায়গা থেকে যদি আমাদের বলা হয়, আমরা সরকারের অংশ, সেটি প্রতিটি রাজনৈতিক দলসহ দেশের সব জনগণ সরকারের অংশ। অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ‘৭১ পরবর্তী স্মরণকালের সব থেকে বেশি জনপ্রিয় ও জনসম্পৃক্ত সরকার। নির্দিষ্টভাবে আমাদের সরকারের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা অমূলক।
রূপালী বাংলাদেশ: চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিলসহ বৈষম্যহীন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন, সে ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈষম্য দূর করা কতটুকু সম্ভব হয়েছে, সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কী কাজ করছে?
হাসনাত আবদুল্লাহ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ এবং বের হওয়া দুটিই কঠিন। সরকারি সেক্টরে বেশি নিরপত্তা থাকার ফলে জনগণের আলাদা ঝোঁক রয়েছে এ চাকরিতে। বর্তমান সরকার মাত্র ৬ মাস ক্ষমতায় রয়েছে, যা সার্বিক সংস্কার করার ক্ষেত্রে খুবই স্বল্প সময়। তার সঙ্গে নানা ইস্যুতে নিয়মিত অবরোধ-আন্দোলন চলমান যেদিকে সরকারকে নজর রাখতে হচ্ছে। তবে, এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বেসরকারি চাকরিতে নিরাপত্তার জন্য ‘শ্রম আইন-২০০৬’ যেটি রয়েছে সেটি সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। একই সঙ্গে, বেসরকারি চাকরিতে যে নিরাপত্তাহীনতা তা নিরসনে কাজ করছে। সংস্কার শেষ হলে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে সুবিধা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি সমতার স্থানে আসবে বলে বিশ্বাস করি।
রূপালী বাংলাদেশ: নির্বাচন দেরি হওয়ার জন্য আপনারা কোন ধরনের ভূমিকা রাখছেন?
হাসনাত আবদুল্লাহ: অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে মাত্র ৬ মাস, এমন নয় সরকারের ২-৪ বছর পার করেছে। সঠিক গণতন্ত্রের ধারা বজায় রাখতে, ফ্রি-ফেয়ার. অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে ন্যূনতম প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। সব মহলের কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে সংস্কার ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত সম্ভব নয়। আমরাও চাই দ্রুত নির্বাচন হোক। তবে, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য যে সংস্কারগুলো করা প্রয়োজন, সেগুলো হয়ে তারপরই নির্বাচন হোক।
রূপালী বাংলাদেশ: বর্তমান সরকারের ৬ মাসে নানা ইস্যুতে অবস্থান, অবরোধসহ আন্দোলন চলছে তাতে জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। এ পরিস্থিতে সরকারের দুর্বলতা দেখেন কি না?
হাসনাত আবদুল্লাহ: না, অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান আন্দোলন ইস্যুতে কোনো দুর্বলতা দেখি না বরং সরকার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে জনগণের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। চাইলেই অন্তর্বর্তী সরকার এক মাস বা দুই মাস একটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সব আন্দোলন বন্ধ করতে পারত। তবে, আন্দোলন যতই অযৌক্তিক হোক তাদের সরকার কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে। আগের সরকারের মতো নিপীড়নমূলক বাকস্বাধীনতার ওপর কোনো বাধা দিচ্ছে না। ক্রাইসিস সময়ের মধ্যে আগের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের মতো কোনো আন্দোলনে নিবর্তনমূলক আইনের ব্যবহার করেনি বর্তমান সরকার, যেটি আগমীর গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
রূপালী বাংলাদেশ: বাকস্বাধীনতার সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলো কি? বিদেশি মিডিয়া যেখানে প্রচার করছে জুলাই-অভ্যুত্থান একটি ইসলামিস্ট অভ্যুত্থান। বিভিন্ন মাজারে হামলা, শিল্পীদের কাজে বাধাসহ সর্বশেষ বইমেলায় হামলা...?
হাসনাত আবদুল্লাহ: অভ্যুত্থান পরবর্তী বিভিন্ন ইস্যুতে সামাজিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলো আমরা অস্বীকার করছি না। দীর্ঘ সময় মানুষ বঞ্চিত থাকার মধ্য দিয়ে যে প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছিল, তারা ভেবেছিল দ্রুততম সময়ের মধ্য দিয়ে এ সরকার তাদের সব আশা-আকাক্সক্ষাপূরণের প্রত্যাশিত জায়গায় নিতে পারবেন, সেখান থেকেই সংকট তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে, ভারতীয় কিছু মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে ধর্মীয় দাঙ্গা, মানুষ ইসলামপন্থিদের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার এমন মিথ্যা সংবাদ ও অসত্য তথ্য ছড়াচ্ছে। এরই মধ্যেই তাদের সব সংবাদ অসত্য হিসেবে প্রমাণ হয়েছে। তবে, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা, যা ঘটছে এগুলো কখনোই কাম্য নয়। বইমেলাই যে ঘটনা ঘটেছে, তার বিবরণ পেয়েছি। দেশের সব মানুষের কাছে আহ্বান থাকবে অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের সংকট মোকাবিলাই ধৈর্যশীল আচারণ করতে হবে। কোন বিষয়ে উত্তেজিত বা অতি-উৎসাহী হয়ে যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি থেকে দূরে থাকতে হবে।
বলা বাহুল্য, বিগত সরকারের সময়ে দেশ থেকে ২৬০ বিলিয়নের বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, আইন ও সুশাসন ধ্বংস হয়েছে, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করা হয়েছে, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নতুন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, আমরা সেখানে এ সমস্যাগুলোর কিছুটা প্রভাব এখনো রয়েছে। ফলে, সবার কাছে আহ্বান থাকবে এই সংকটকালীন আমরা রিঅ্যাক্টিভ না হয়ে যায়। দীর্ঘদিন আমরা যে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, সেটি বাস্তবায়নে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহনশীল আচরণ করি।
রূপালী বাংলাদেশ: ধন্যবাদ আপনাকে।
হাসনাত আবদুল্লাহ: রূপালী বাংলাদেশকে ধন্যবাদ।
আপনার মতামত লিখুন :