ঢাকা সোমবার, ০৩ মার্চ, ২০২৫

মধ্যপন্থার দল হতে চায় এনসিপি, তাহলে প্রশ্ন উঠছে কেন?

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৫, ০৯:০৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে সদ্য আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নিজেদের মধ্যপন্থার দল হিসেবে দাবি করেছে। কিন্তু দলটিতে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থেকে আসা নেতাদের একই চরিত্র ধারণ করে মধ্যপন্থার একই লক্ষ্য নিয়ে এগুনোটাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন ঘটনায় এসব নেতাদের কারও কারও ভূমিকা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন থাকায় তাদের সমন্বয়ে গঠিত দলটি শেষ পর্যন্ত কতটা মধ্যপন্থার নীতি ধারণ করতে পারবে তা নিয়েও নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। দলটি গঠনের পরেও এর দুজন ‍‍`প্রভাবশালী সংগঠক‍‍` নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যে পোস্ট দিয়েছেন তাও মধ্যপন্থা কিংবা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির সঙ্গে যায় না বলে অনেকে মনে করেন। আবার দলের মূল নেতৃত্বে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি একেবারেই কম। এখন আবার নতুন বিতর্ক উঠেছে এলজিবিটিকিউ নিয়েও।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একই ধারায় রাজনীতির কথা বলে থাকে। সেখানে নতুন এই দলটি মধ্যপন্থা রাজনীতিতে কতটা অবস্থান তৈরি করতে পারে তা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মধ্যপন্থা বলতে তারা বিভাজিত রাজনীতির অবসানের কথা বুঝিয়েছেন, যেখানে কেউ কাউকে খারিজ করে দেবেনা। "তবে জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো এ মুহূর্তে আমরা দলীয় ক্ষেত্রে বিবেচনা করছি না," বলেছেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলছেন মধ্যপন্থার কথা বলে মূলত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্পেস বা জায়গা তৈরির চেষ্টা করছে এনসিপি। তবে শেষ পর্যন্ত দলটিতে মধ্যপন্থার চর্চা কতটা থাকে সেটি দলটির দর্শন, কর্মসূচি ও ইস্যুভিত্তিক বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হবে বলে মনে করেন তারা।

মধ্যপন্থার বিষয়ে আসলে কি বলা হয়েছে
শুক্রবার দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, "সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই"। এর আগে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেশের মানুষকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সদস্য সচিব আখতার হোসেন যে ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন সেখানেও মধ্যপন্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন "আমরা রাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা বলেছি। ডান-বামের ও মধ্যমপন্থার কথা বলেছি। মানুষের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলেছি। আমরা আশাবাদী, আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সকল-ধর্ম বর্ণ লিঙ্গের মানুষের অংশগ্রহণ করবেন"।

এছাড়া সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে দলটির একজন সংগঠক সারজিস আলম বলেছিলেন, "আমাদের এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্ম হচ্ছে, এখানে থাকবে মধ্যপন্থার রাজনীতি। এখানে থাকবে বাংলাদেশপন্থা"।

তাহলে প্রশ্ন উঠছে কেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলছেন, তার ধারণা দেশের মানুষ যেহেতু চরমপন্থা বা কোন এক দিকে পুরোপুরি হেলে পড়া পছন্দ করে না বলেই মানুষের মধ্যে জায়গা করার জন্য এখন মধ্যপন্থার কথা বলছে দলটি।

"কিন্তু বাস্তবতা হলো দলটির সংগঠকদের গত বছর অগাস্ট থেকেই মানুষ দেখছে। এর মধ্যে তাদের অনেকে এমন অনেক ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়েছেন যেগুলো মধ্যপন্থার চেতনার সাথে যায় না। তাদের ঘোষিত কোন কর্মসূচিও নেই। মনে হচ্ছে অপ্রস্তুত অবস্থায় মাঠে নেমেছেন তারা," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আরেকজন বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, দলটিতে বিভিন্ন মতাদর্শের সংগঠন থেকে আসা লোকজন রয়েছে এবং মধ্যপন্থার নীতিতে যেতে হলে তাদের সবাইকে সেই একই আদর্শের চর্চা করতে হবে।

"সামনে বিভিন্ন ধরনের ইস্যু যখন আসবে। তখন কারা ছিটকে যাবে আর কারা টিকে থাকবে সেটার ওপরেও নির্ভর করবে যে আসলে দলটির বৈশিষ্ট্য কেমন হবে। প্রথম কমিটিতেই একজনকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর দলের দুজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়টাই কিন্তু সামনে নিয়ে এসেছেন," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত, জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রথম কমিটি ঘোষণার পর কমিটিরই একজন নেতার লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে দলটির ভেতর থেকেই। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের বিতর্কের পর দলের দুই প্রভাবশালী নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন যে ‍‍`রাজনীতির আগে তাদের পরিচয় তারা মুসলমান‍‍`।

রাশেদা রওনক খান বলছেন, মধ্যপন্থার কথা বলা সহজ কিন্তু এ নীতিতে অবিচল থাকাটা চ্যালেঞ্জের। "শুরুতেই দেখা যাচ্ছে যেই অবস্থানে অটল থাকার কথা, সেখান থেকে সরে আসতে তারা বাধ্য হচ্ছেন"।

আরিফুল ইসলাম আদীব অবশ্য বলছেন মধ্যপন্থা বলতে তারা বোঝেন যে রাষ্ট্র সবার প্রতি সমান আচরণ করবে এবং সেই নীতিই তাদের থাকবে।

"ধর্ম, বর্ণ, পেশা কিংবা অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে কাউকে আলাদা করা বা খারিজ করে দেয়া হবে না," বলছিলেন তিনি। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলন হয়েছে। এরপর আন্দোলনকারীদের একাংশ যখন জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করলো সেখানেও গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরি করা বলা হয়েছিলো, যা সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম লক্ষ্য।

শুক্রবার নতুন এই দলটির আত্মপ্রকাশ হলেও সেখানে দলীয় দর্শন ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। ফলে মধ্যপন্থার কথা এর নেতারা বললেও শেষ পর্যন্ত দলীয় আদর্শ কী হয় তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে অনেকের মধ্যে। "সাধারণত এগুলো জানিয়েই মাঠে নামতে হয়। কিন্তু এই দলটির আদর্শিক অবস্থান কোথায় এবং তারা দল ও দেশকে কোথায় নিতে চায় তা তারা পরিষ্কার করতে পারেনি। মতাদর্শ পরিষ্কার না হলে এবং লিখিত দর্শন ও কর্মসূচি না আসা পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন বক্তব্য আসতেই হবে," বলছেন মোহাম্মদ মজিবুর রহমান।

তার মতে, মুখে মধ্যপন্থার কথা বললেও সেটায় তারা স্থির থাকতে পারবে কি-না তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। "গত কয়েক মাসে বিভিন্ন ঘটনায় তাদের ভূমিকা মানুষ কিন্তু দেখেছে। সেখান থেকে তাদের রাজনীতি কোন কেন্দ্রিক হবে সেটাও কিন্তু মানুষ কিছুটা ধারণা করছে। আমার ধারণা সেজন্যই দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায়নি"। রাশেদা রওনক খানও বলছেন, এই দলটির নেতারা একটি অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেখানে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো।

"কিন্তু রাজনীতির মাঠ ভিন্ন বিষয়। অভ্যুত্থানের জনজোয়ারের রেশ কিন্তু সেদিন দলের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মানুষ কিন্তু হিসেব নিকেশ করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত দলটি মধ্যপন্থাতে অবিচল থাকবে কি-না তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে। কিভাবে সব মতের সমন্বয় ঘটাবে তারা সেটার ওপরও এটি নির্ভর করবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।