চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় মোট ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। সে অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। তবে এ বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের পরেও দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং অপরাধ বৃদ্ধি এবং পুলিশের মনোবল নেমে যাওয়ার কারণে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশ বাহিনী ব্যাপক জনরোষের শিকার হয়েছে। ফলে পুলিশের কার্যক্রমে ধীরগতি এসেছে। দেশের বড় শহরগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধের ঘটনা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সন্ধ্যা ও রাতে রাজধানী এবং অন্য শহরগুলোতে অপরাধীদের কার্যকলাপ বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের চলাচল উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। পুলিশও অনেক জায়গায় হামলার শিকার হচ্ছে। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
এদিকে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি, কাঠামোগত পরিবর্তনও জরুরি হয়ে পড়েছে। পুলিশের কার্যক্ষমতা পুনর্স্থাপন করতে হলে পুরোনো কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা এবং নতুনভাবে কাজ শুরু করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, বিশেষজ্ঞরা এবং নাগরিক সংগঠনগুলো বলছে, পুলিশ বাহিনীর ইমেজ পুনঃস্থাপন এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, বর্তমান বাহিনীর কার্যক্রমে সংস্কার ও নবচেতনার প্রয়োজন।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো দেশ চলতে পারে না উল্লেখ করে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিচালক ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য নাসির উদ্দিন এলান দেশের এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পুলিশ এবং পুলিশের স্থাপনাগুলো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এর পর থেকে পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে। তবে এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। পুলিশকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং জননিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ যদি এটা না পারে তাহলে দেশে একের পর এক বিশৃঙ্খলা ঘটবে।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তায় খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকার বেশি। নাগরিকরা সত্যিকার অর্থে কি সে তুলনায় কোনো সার্ভিস পাচ্ছে? ফ্যাসিবাদী সময়কালে পুলিশের ইমেজের যে ক্ষতি এবং তার ফলে যে পরিণতি হয়েছে; বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এর বাস্তবিক কোনো সমাধানই বের করতে পারেনি। সরকার এটিকে স্বাভাবিক পন্থায় সমাধানের যে পথে হাঁটছে তা পুরোই ব্যর্থ হবে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, এ পুলিশ বাহিনীর মনোবল ও ইমেজ শিগগিরই ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখি না। সেক্ষেত্রে খুব দ্রুত একটা নতুন বিশেষ বাহিনী রিক্রুট করা উচিত, যারা বিগত নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়কার অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করবে।’
অনেকটা একই বক্তব্য জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবের। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো ফ্যাসিবাদের সময়ের কাঠামো থেকে বের হতে পারেনি। একই সঙ্গে তারা সরকারের ভেতর থেকে জননিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরং জনগণকে আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখছেন। নানা আন্দোলন হলে সেখানেও আগের মতো হামলা, লাঠিচার্জ চলছে। আইন-শৃঙ্খলা উন্নতি করতে হলে শুধু খরচ বাড়িয়ে নয়, বরং কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। যেসব অফিসার সরাসরি দুর্নীতি ও গুম-খুনে জড়িত তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’
পুলিশ বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাহিনীটির সদস্যরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির চলমান টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় ৬৫০টির বেশি টহল দল মোতায়েন থাকে। ৭০টির বেশি চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোয় ব্লক রেইড পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘পুলিশ তার পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি পুলিশ সদস্য কাজ করে যাচ্ছেন। রাজধানীসহ সারা দেশেই টহল ও তল্লাশিচৌকির কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে পুলিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’