ভিওএলটিই চুক্তির অনুমতি পেল দেশের এমএনওরা

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম

ভিওএলটিই চুক্তির অনুমতি পেল দেশের এমএনওরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ইন্টারন্যাশনাল রোমিং সেবার পরিধি বাড়াতে বহির্বিশ্বের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা প্রদানকারী অপারেটরদের সঙ্গে ‘ভিওএলটিই’বিষয়ক সরাসরি চুক্তির অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা (এমএনও)। 

বাংলাদেশে কার্যক্রমে থাকা এমএনওদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই অনুমতি দেয়। 

ফলে দেশের বাইরে সফররত ব্যবহারকারীদের জন্য ইন্টারন্যাশনাল রোমিং দেওয়ার পরিধি পূর্বের তুলনায় বাড়াতে পারবে দেশের অপারেটরগুলো। আবার বিদেশি অপারেটরগুলোর ব্যবহারকারীদেরও বাংলাদেশে উন্নত টেলিযোগাযোগ সেবা দেওয়া যাবে। 

ইন্টারন্যাশনাল রোমিং সুবিধায় দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী বিদেশ ভ্রমণের সময় নিজের সিম কার্ড পরিবর্তন না করেই মোবাইল নেটওয়ার্ক কাভারেজ পেয়ে থাকেন। 

অর্থাৎ নম্বর পরিবর্তন না করেই বা ভ্রমণরত দেশের স্থানীয় সিম কার্ড না কিনেই, দেশের সিম কার্ড দিয়েই স্থানীয় মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে ইন্টারন্যাশ রোমিং ব্যবস্থা। গ্রাহকদের এই সেবা প্রদানে বিভিন্ন দেশের অপারেটরগুলোর মধ্যে এ বিষয়ক চুক্তি থাকে। 

বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক সেবা প্রদানকারী অপারেটর (গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি এবং টেলিটক) এতদিন এই সেবা দিত ২জি এবং ৩জি নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে। 

অর্থাৎ দেশের অপারেটর বিদেশি অপারেটরের ২জি এবং ৩জি নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবহারের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল। দেশের অপারেটরদের ব্যবহারকারীরা বিদেশে রোমিং সুবিধার আওতায় ভয়েস কলের ক্ষেত্রে ২জি এবং ডাটা তথা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৩জি নেটওয়ার্ক পেত। 

তবে বিশ্বের অনেক দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা (এমএনও) নিজেদের বাজারে ২জি এবং ৩জি সেবা বন্ধ করেছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যবহারকারীরা বিশ্বের অনেক দেশে অবস্থানকালে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং সুবিধা পাচ্ছেন না। 

যদিও নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষায় ইন্টারন্যাশনাল রোমিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদেশে গিয়ে রোমিং সেবা না পাওয়ায় দেশের একটি অপারেটরের বিরুদ্ধে শীর্ষ পর্যায়ের একজন ব্যবসায়ীর ক্ষতিপূরণ মামলা দায়েরও নজির রয়েছে। 

দেশীয় টেলিযোগাযোগ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন পেশাজীবী বিশেষ করে সেবা খাতে কর্মরত ব্যক্তিরা; রাষ্ট্রীয়, আর্থিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইন্টারন্যাশনাল রোমিংয়ের মতো সেবা বিদেশ ভ্রমণে অপরিহার্য। 

পর্যটনবিষয়ক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হালিমা ইয়াসমিন মুক্তা বলেন, দেশে বা দেশের বাইরে গ্রাহকদের ভ্রমণ স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে ভিসা, হোটেল বুকিং, ট্যুর প্যাকেজ এবং এয়ার টিকিটের মতো সেবা দেওয়াই আমার দায়িত্ব। 

ভ্রমণকালে যেকোনো পরিস্থিতিতে বা জরুরি মুহূর্তে আমার গ্রাহকের হয়তো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন পড়ে। এমন মুহূর্তে যদি আমিই যোগাযোগের বাইরে থাকি, তাহলে আমার ক্লায়েন্টকে কীভাবে সেবা দেব? দেশ থেকে যারা যোগাযোগে আগ্রহী, তাদের কাছে তো আমার দেশীয় নম্বর দেওয়া। 

কাজেই বিদেশে গিয়ে সেখানকার সিম কিনলেও, অনেক সময় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কল ধরা যায় না। যিনি ফোন দিচ্ছেন, তিনি হয়তো সরাসরি নম্বরে কল দিচ্ছেন; হোয়াটস অ্যাপ বা এ ধরনের মাধ্যমে কল দিচ্ছেন না। আবার অনেক দেশে এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা থাকে। তখন বেশ বিপাকেই পড়তে হয়। 

‘গ্লোবাল ফুটওয়্যার’ নামক এক অনলাইন শপের কর্ণধার আমিন উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি সিঙ্গাপুর সফর করি। দেশে থাকতে এক ভেন্ডরকে মোটা অঙ্কের চেক দিয়ে আসি তার পেমেন্ট হিসেবে। এই চেক তিনি যেদিন ব্যাংকে জমা দেন ক্যাশ করতে, সেদিন আমি সিঙ্গাপুর। 

ব্যাংক থেকে কল দিয়ে আমার দেশের নম্বর বন্ধ পাওয়ায়, সেই ভেন্ডর সেদিন চেক অনার করাতে পারেনি। সে আমার অফিসে পণ্যও পাঠায়নি। ঈদের আগে এমন ঘটনায় বেশ বিপাকেই পড়তে হয়। দেশে আসলে, তাকে আবার চেক জমা দিতে বলি। এরপর ব্যাংক থেকে দেওয়া ফোন রিসিভ করলে, তিনি টাকা পান। 

আমার সিমের ইন্টারন্যাশনাল রোমিং চালু করা। ভেবেছিলাম সিঙ্গাপুরে এই সুবিধা পাব। সেখানে পৌঁছানোর পর প্রায় ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও যখন রোমিং পাইনি, তখন স্থানীয় সিম কিনি। 

এই সমস্যা এবং সমস্যার সমাধান ‘ভয়েস ওভার লং টার্ম ইভোলিউশন (ভিওএলটিই)’ ব্যবস্থার কারিগরি দিক ব্যাখ্যা করে নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ফোন কল সাধারণত ২জি’র ওপর দিয়ে যায় এবং ডাটা বা ইন্টারনেট থ্রিজি, ফোর-জি’র ওপর দিয়ে যায়। 

দেশের অপারেটররা নিজেদের ব্যবহারকারীদের চড়া দামে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং দিচ্ছে। অন্যদিকে তারা বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে ২জি এবং থ্রিজি’র চুক্তি করত। আপনি যে দেশে যাবেন, সেখানে যদি ৫জি’ও থাকে, দেখবেন যে ৫জি পাচ্ছেন না। কারণ অপারেটরগুলো শুধু ২জি, থ্রিজি সেবার চুক্তি করেছে যেন নিজেদের খরচ কমে।

তিনি বলেন, বিদেশি অপারেটরদের থেকে তারা ফোর-জি বা ফাইভ-জি সাবস্ক্রাইব না করে ২জি, ৩জি সাবস্ক্রাইব করত। কাজেই অনেক দেশ এখন ২জি এবং থ্রিজি একেবারে করলে, দেশের অপারেটরগুলো বিপাকে পড়ে। 

এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে ভিওএলটিই যার মাধ্যমে থ্রিজি, ফোরজি বা ফাইভজি’র ওপর দিয়ে ভয়েস এবং ডাটা দুটোই পাঠানো যায়। এমনকি ভিওএলটিই’র মাধ্যমে বাসাবাড়ির ওয়াইফাই দিয়েও ভয়েস ও ডাটা আদান করা যায় অর্থাৎ আপনার বাসায় ওয়াইফাই থাকলে সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই আপনি কাউকে কল করতে পারবেন। 

এই সুবিধা নিয়ে বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তি করার অনুমতি চাচ্ছিল অপারেটরগুলো। এটা দেওয়া উচিত (বিটিআরসি দিয়েছে), না দেওয়ার তো কারণ নেই। বরং এটা আরও আগে দিলে মাঝে গ্রাহকরা যে ভুগল, সেটা হতো না। 

অন্য আরেকটি মোবাইল অপারেটরের প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, “বর্তমান অবস্থায় রোমিং সুবিধায় বিদেশে থাকা একটি মোবাইল নম্বর থেকে যখন কল করা হয়, সেটি জিএসএম (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন) হয়ে আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) এবং আইসিএক্স (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) হয়ে কলটা আসে। 

কিন্তু অনেক দেশে ২জি, ৩জি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ ব্যবস্থায় রোমিং পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য ভিওএলটিই’র মাধ্যমে রোমিং সেবা দেওয়া হবে। এই ব্যবস্থায় পূর্বের তুলনায় কম খরচে রোমিং সেবা দেওয়া যাবে এবং এর গুণগত মানও পূর্বের তুলনায় ভালো”। 

এ ছাড়াও রোমিং সুবিধায় ক্রেডিট কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক হওয়ায় এই সেবার পরিধি বাড়ানো যাচ্ছে না বলেও জানান টেলিকম খাত সংশ্লিষ্টরা। দেশীয় মুদ্রায় রোমিং সেবার অর্থ পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়ে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে রোমিং সেবা নিচ্ছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৫ শতাংশেরও কম। 

অথচ এই সেবার অনেক চাহিদা রয়েছে, টেলিকম ব্যবসার এটি এখন উদীয়মান পণ্য বা সেবা। অনেক প্রবাসীর রোমিং করা সিম দরকার হয় কিন্তু ক্রেডিট কার্ড না থাকায় প্রথমেই তারা হোচট খায়। 

তারা কিন্তু তাদের চাহিদা ঠিকই পূরণ করছে, বিদেশে গিয়ে সিম কিনছে। এতে করে দেশের অর্থ বিদেশ চলে যাচ্ছে। এই সেবা যদি দেশীয় মুদ্রায় নেওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে গ্রাহকরা সহজেই সেবা পাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রায় সাশ্রয় হবে। 

মোবাইল অপারেটরগুলোকে বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে ভিওএলটিই চুক্তির অনুমতি প্রদানের বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছে দেশের অপারেটরগুলো। 

রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, “বিশ্বের বেশকিছু দেশে ইতোমধ্যেই ২জি এবং ৩জি পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে, এবং অনেক দেশ এ পরিষেবা বন্ধের পরিকল্পনা করছে।

 যেসব দেশে বা অপারেটরের ২জি/৩জি পরিষেবা নেই, সেইসব নেটওয়ার্ক থেকে ভয়েস কল করার একমাত্র উপায় হলো ভিওএলটিই কল, যা মূলত ফোরজি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। 

বাংলাদেশের গ্রাহকরা বিদেশে ভ্রমণের সময় যদি এমন কোনো অপারেটরের রোমিং সেবা গ্রহণ করেন, যাদের ২জি/৩জি পরিষেবা বন্ধ রয়েছে, তাহলে সেই নেটওয়ার্ক থেকে ভয়েস কল করার একমাত্র উপায় হবে ভিওএলটিই। 

এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের হোস্ট অপারেটর (রবি বা অন্য কোনো দেশীয় অপারেটর) এবং বিদেশি অপারেটরের মধ্যে অবশ্যই ভিওএলটিই রোমিং চালু থাকতে হবে। 

ভওএলটিই রোমিং এর অনুমতি না থাকায় অনেক দেশেই বাংলাদেশের রোমিং গ্রাহকরা সঠিকভাবে ভয়েস পরিষেবা পাচ্ছিলেন না বিশেষত যেসব দেশে ২জি/৩জি পরিষেবা বন্ধ হয়েছে । ভিওএলটিই রোমিং অনুমোদনের ফলে রোমিং গ্রাহকরা ২জি/৩জি পরিষেবা বন্ধ হযে যাওয়া দেশে বা অপারেটরে সঠিকভাবে ভয়েস পরিষেবা পাবেন, তাছাড়া উচ্চগতির এইচডি ভয়েস কল ও দ্রুত কল সংযোগ উপভোগ করতে পারবেন, যা ২জি/৩জি রোমিংয়ের তুলনায় অনেক উন্নত। সর্বোপরি, উন্নত গ্রাহকসেবা প্রদানে এই উদ্যোগটি দেশের টেলিকম শিল্পে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!