কেন সক্রিয় হচ্ছে না পুলিশ?

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৫, ১২:০০ পিএম

কেন সক্রিয় হচ্ছে না পুলিশ?

ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংগঠিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ৭ মাস অতিক্রম হলেও পুলিশ তার কর্মকাণ্ডে পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি। এর ফলে বেড়েছে খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ।

সূত্র  জানায়, পুলিশ এখনো নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পুলিশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বদলির জন্য অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘কানভারী করার’ অভিযোগ পাওয়া গেছে। পোস্টিং প্রতিযোগিতার কারণে নিজ কর্মস্থলে শতভাগ মনোযোগী হয়ে কাজ করছেন না পুলিশ সদস্যরা। আবার কিছু কর্মকর্তা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ মেলাচ্ছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা ভেবেছেন নির্বাচিত সরকার এলে তারা জোরেশোরে কাজ করবেন। এতে পুলিশের কর্মকাণ্ড কমে গেছে।  

সূত্রের বরাত দিয়ে  জানা যায় মূলত পুলিশ পুরোপুরি সক্রিয়ভাবে কাজ না করার পেছনে রয়েছে ৭টি কারণ। কারণ গুলো হলো:

১। জুলাই ও আগস্টের গণআন্দোলনে পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করার কারণে সারা দেশের মানুষের মধ্যে পুলিশের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এ কারণে তারা মাঠপর্যায়ে আর আগের মতো আমজনতার শ্রদ্ধা পাচ্ছে না। এটি পুলিশের মধ্যে একটি ট্রমা সৃষ্টি করেছে। এই ট্রমা এখনো কাটাতে পারেনি বাহিনীটি। এ কারণে পুলিশ তার কর্মকাণ্ডে শতভাগ সক্রিয় হতে পারেনি।

২। মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার কারণে কোনো বড় অভিযানে গেলে সাধারণ মানুষ পুলিশের ওপর চড়াও হতে পারে এমন ভয় থাকায় তারা ঘটনাস্থলে যাচ্ছে না। ফলে অপরাধীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। আর এ কারণে বাড়ছে অপরাধের মাত্রা।

৩। জুলাই আন্দোলনে এক হাজার ৯৪টি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এখনো পুলিশের বিভিন্ন শাখায় গাড়ি দিতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ কারণে পুলিশের যানবাহন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। যানবাহন সংকটের কারণে জরুরি ভিত্তিতে তারা অপারেশনে যেতে পারছে না।

৪। পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। নির্বাচিত সরকার এলে নতুন উদ্যমে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ কারণে অনেক পুলিশ সদস্য পূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন না।

৫। বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের স্পটভিত্তিক চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। যেসব স্থান থেকে তারা চাঁদাবাজি করে থাকে, সেখানে ৫ আগস্টের পর তারা কম যাচ্ছেন। কারণ চাঁদা চাইতে গেলে জনগণের রোষানলে পড়তে হতে পারে, এমন ভয়ে তারা সেখানে যাচ্ছেন না। এতে সেখানে চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয় হয়েছে। এতে পুলিশের টহল জ্যামিতিক হারে কমে গেছে।

৭। ঢাকাসহ তৃণর্মূল পর্যায়ে বদলির প্রভাব, বর্তমান পুলিশের অ্যাকশনে গেলে শাস্তির ভয় এবং ডিএমপির ক্রাইমবেজ না বোঝা ও বদলি হওয়ার পর নতুন স্থানের পথঘাট না চেনার কারণে পুলিশ পুরোপুরি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে সারা দেশে ২৯৪ জন খুন হয়েছেন। এ সময় নিপীড়নের শিকার হয়েছে এক হাজার ৪৪০ নারী-শিশু। একই সময়ে ১০৫টি অপহরণ, ৭১টি ডাকাতি ও ১৭১টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে খুন হয়েছে ৯৪৭ জন।

এদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পুলিশকে বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে আরো সক্রিয় করা হয়েছে।

সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ কেন ফাংশন করছে না, তার জন্য মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করায় সারা দেশে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এর ফলে পুলিশের কিছু সদস্য ট্রমায় ভুগছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুলিশকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ, মোটিভেশনাল ট্রেনিং দেওয়া ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একজন ডিসি বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশের কয়েকটি ঘটনায় কাজে স্পৃহা পাচ্ছেন না তারা। সাবেক আইজিপিসহ একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের নামে মামলা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশের একটি অংশ কাজ করছে না। তাদের অনুমান, বাড়তি কাজ করতে গেলে তার বিরুদ্ধে পরের সরকার অ্যাকশন নিতে পারে। পুলিশের একটি অংশ রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে।

পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। তারা হলেন- ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ক্যাপ্টেন ইমন, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সুব্রত বাইন, আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন এবং খোরশেদ আলম ওরফে রাসু প্রমুখ। এরা কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাদের লোকজনও সক্রিয় হয়েছে। এতে গ্রুপের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে দখল, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। ঢাকায় যেসব পুলিশ কর্মকর্তা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা বদলি হয়ে গেছেন। এতে শীর্ষ সস্ত্রাসীদের গ্রুপ, তাদের লোকজন কারা এবং তারা কোন কোন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন, তা দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন পুলিশ কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন না। এতে পুলিশের মাঠপর্যায়ের কাজের দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর পুলিশ তার শক্তি প্রয়োগে নমনীয় হয়েছে। কোনো কঠোর অ্যাকশনে গেলে শাস্তির খড়গ নেমে আসবে এই ভয়ে তারা শতভাগ পুলিশিং করতে পারছেন না। এ কারণে পুলিশের কর্মকাণ্ড কমে গেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অপরাধীরা এক স্থানে অপরাধ করে আরেক স্থানে পালিয়ে থাকে। আবার কিছু ভাসমান অপরাধী চক্র রয়েছে। ঢাকায় দায়িত্ব পালনে পূর্বের অভিজ্ঞতা না থাকলে অপরাধ দমন করা দুরূহ। ঢাকায় দায়িত্ব পালনের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা ও ক্রাইমবেজ না বোঝার কারণে পুলিশ সক্রিয়ভাবে ফাংশন করছে না বলেও জানান তারা।

আরবি/এসবি

Link copied!