ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ, ২০২৫

উত্তপ্ত বাংলা, অধিবেশন ডাকলেন ইয়াহিয়া

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২৫, ১০:৪৩ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

৬ মার্চ ১৯৭১। এদিন ঢাকায় লাগাতার ছয় দিনের হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে। এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন, যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি, ততদিন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব। এ সময় তিনি ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু বলেন, শহিদদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না।

ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডির পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।

পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান। 

অন্যদিকে লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।

৬ মার্চ বেলা ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হন। রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর সশস্ত্রবাহিনীর গুলিতে ১ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হন। সান্ধ্য আইন অব্যাহত থাকে। খুলনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গুলিবর্ষণে ১৮ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত হন।

একাত্তরের মার্চের শুরুতে সারা দেশ তখন সভা-সমাবেশ-মিছিলে মিছিলে উত্তাল। ৬ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে তখনকার পূর্ব বাংলার আন্দোলনরত জনগণকে তিনি ‘দুষ্কৃতকারী’ আখ্যা দেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর সারা দেশ ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। সারা দেশের বিক্ষোভ মিছিলে ‘পরিষদে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। আগের কয়েক দিনের মতোই অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখে বাংলার মুক্তিকামী জনতা।

ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানান।

হরতাল পালনে ষষ্ঠ দিনের মতো সর্বস্তরের জনতা নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে আগে বেতন দেওয়া হয়নি, সেসব অফিস খোলা রাখা হয়। ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের সব বেতার কেন্দ্র থেকে রিলে করার দাবি জানান।

লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ-শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য শেখ মুজিবকে দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জানান, ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে। আর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেবেন, তা জানতে বাংলার মুক্তিকামী জনতা তখন অধীর অপেক্ষায়।

বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যান। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হন। রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর গুলি চলে, সেখানে অন্তত ১ জন নিহত হন। খুলনায় সংঘর্ষ আর গুলিতে ১৮ জন নিহত, ৮৬ জন আহত হন।

শহিদ জননী জাহানার ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ নিয়ে লিখেছেন, ‘আগামীকাল রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ সাহেব কী বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। এক তারিখে হোটেল পূর্বাণীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচির ঘোষণা তিনি সাত তারিখে দেবেন। 

কিন্তু এ কদিনে ঘটনা তো অন্য খাতে বইছে। এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে শত শত লোক নিহত-এর পরিপ্রেক্ষিতে শেখ সাহেব আগামীকাল কী ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছে, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, দূর, তা কী করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার। 

উনি দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে। কেউ বলছে, আগামীকাল মিটিংয়ের ব্যাপারে ভয় পেয়ে ইয়াহিয়া আজ ভাষণ দিচ্ছে।’