বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, যা ‘মব জাস্টিস’ নামে পরিচিত। এটি এমন একটি প্রবণতা যেখানে একটি সংঘবদ্ধ দল নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে কাউকে পিটিয়ে মারধর বা হত্যার চেষ্টা করে। সম্প্রতি ‘মব জাস্টিস’-এর ঘটনা ব্যাপক আকারে ঘটছে। ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরমভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে।
মব জাস্টিসের আওতায় ঘটা সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে— জনগণের যে কাউকে গণপিটুনি দেওয়া, অবৈধভাবে বাড়িতে ঢুকে লুটপাট করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে কাউকে ছিনিয়ে নিয়ে মারধর করা। এমনকি কখনো কখনো হত্যাও করা হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক সময় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী এবং সাধারণ মানুষের ওপরও এ ধরনের হামলা হচ্ছে। একাধিক জায়গায় এমন ঘটনা ঘটছে যা সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে এবং জনমনে ভীতি তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মব জাস্টিসের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে পড়েছে। গত কয়েক মাসে এর পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এই পরিস্থিতি যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে সরকারের স্থিতিশীলতায় হুমকি আসতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের হামলার পেছনে রয়েছে বিগত সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন। ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এবং অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। আর এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মব জাস্টিসের ঘটনাগুলো ঘটছে।
সম্প্রতি এই মব জাস্টিসের শিকার যে শুধু চোর, ডাকাত বা ছিনতাইকারীরাই হচ্ছেন, এমনটা নয়; বরং রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, এবং অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পর্যন্ত হামলার শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এই মব জাস্টিস, যে অনেকে অপরাধ না করেও বিভিন্ন সময় হামলা ও হত্যা শিকার হচ্ছেন।
এ ছাড়া, একাধিক স্থানে ভাস্কর্য, মাজার, এবং শিল্পকারখানায় হামলা ও ভাঙচুরও হয়েছে। আর এই ধরনের ঘটনাগুলো গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে ফেলছে।
তবে এই মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে যে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। সরকার বারবার এর বিরুদ্ধে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। তবে বাস্তবে তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ, গুলশানের একটি বাসায় তল্লাশির নামে তছনছ এবং ভাঙচুর চালানো হয়। যার পরে জানা যায় যে, সেখানে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। আরও একটি ঘটনায়, ভাটারা এলাকায় ইরানি নাগরিকদের মারধর করা হয়, যেখানে তাদের মুদ্রা বিনিময় নিয়ে তর্কের কারণে এই ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় গণপিটুনির ফলে দুজনের মৃত্যু হয়। স্থানীয় মসজিদ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, ডাকাত এসেছে, এরপর সেই অভিযোগে পিটুনির শিকার হন দুই ব্যক্তি, যারা জামায়াতে ইসলামী কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জামায়াতে ইসলামী তাদের হত্যাকাণ্ডের জন্য পরিকল্পিত হামলার অভিযোগ করেছে।
এসব ঘটনার পর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবারও সতর্ক করেছে এবং বলেছে, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব জাস্টিসের ঘটনা দেশের আইন-শৃঙ্খলার ওপর বড় ধরনের চাপ এবং জনমনে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সরকারের উচিত এর বিরুদ্ধে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে এই ধরনের নৃশংসতা রোধ করা সম্ভব হয়।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনা ২০১টি। এতে নিহত ১৭৯ ও আহত ৮৮ জন। ২০২৩ সালে ঘটনা ১১৪, নিহত ৭৩ ও আহত ৯১ জন। এই হিসাবে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। ২০২২ সালে ৭৯ ঘটনায় নিহত ৩৮ ও আহত ৮৩ জন। ২০২১ সালে ৮৩ ঘটনায় নিহত ৪৮ ও আহত ৮৫ জন। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে গণপিটুনিতে মারা গেছে ১৬ ও ফেব্রুয়ারিতে ১১ জন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দরকার হলে সামারি ট্রায়াল করা যেতে পারে। মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সরকার যে কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে, সেটা দৃশ্যমান করা জরুরি। কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য রয়েছে এটা মনে করার যুক্তিসংগত নানা কারণ আছে। একটা সুস্থ সমাজে আইন হাতে তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকতে পারে না। এটা চলতে থাকলে দেশে-বিদেশে ভুল বার্তা যাবে।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, মব সহিংসতার নামে উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা দেখছি। এটা ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে তৈরি করা হচ্ছে। এসব মব ভায়োলেন্সে কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসহায়ত্ব দেখা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মব সহিংসতা ছোঁয়াচে রোগের মতো। এটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এখন যারা মব করছে, তারাও মবের শিকার হতে পারে। তখন সমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তৃত হবে। আইনের প্রতি ভরসা হারাবে। অতি উৎসাহী বা অতি রাগান্বিত হয়ে কারও বিরুদ্ধে দলবদ্ধভাবে সহিংসতা চলতে পারে না।
তিনি বলেন, কোনো অপরাধের তথ্য থাকলে বা কারও বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ থাকলে সুনাগরিক হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো উচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো কারও বাসায় কোনো নাগরিকের তল্লাশি চালানো বা অভিযানের সময় দলবদ্ধ হয়ে বাসায় পুলিশের সঙ্গে থাকার আইনি অধিকার সাধারণ নাগরিককে দেওয়া হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশে মব ভায়োলেন্স ছিল। তা অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
মানবাধিকার কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আওতায় বিচার লাভ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশে হস্তান্তর করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দণ্ডবিধির ১৮৭, ৩১৯, ৩২৩, ৩৩৫ ও ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী অংশ নেওয়া সবাই সমানভাবে দায়ী হবে।
গণপিটুনি হলো মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা ১৯৪৮-এর তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিনিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী, কারও প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না।
আপনার মতামত লিখুন :