ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো অনিশ্চয়তার মুখে আছে দীর্ঘদিন ধরে। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও কোনো কোনো প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। এরমধ্যে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়ে থাকা আরও অন্তত তিন প্রকল্প বাদ দিতে চায় সরকার। এ ছাড়া বেশ কিছু প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজ বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতামত চেয়ে ঢাকায় দেশটির হাইকমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) দেওয়া চিঠির উত্তরও দেশটি।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, পর্যালোচনায় বাদের তালিকায় রেলের তিনটি প্রকল্প রয়েছে। এর একটি হচ্ছে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্পটির মেয়াদ গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে। এখনও প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। এ অবস্থায় ২০২৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা আসার কথা ভারতীয় এলওসি থেকে। বাকি টাকার জোগান দেবে সরকার।
কনস্ট্রাকশন অব ডাবল লাইন রেলওয়ে ট্রাক অন খুলনা-দর্শনা জংশন সেকশন নামে আরেকটি প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। অথচ এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়নি। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ভারতীয় এলওসি থেকে আসার কথা। বাকি ৮১৭ কোটি টাকা সরকারের। প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। এ ছাড়া পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া মিটারগেজ লাইন ডুয়েলগেজে রূপান্তর প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের প্রথম দিন। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। ৫৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এলওসি থেকে আসার কথা ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। বাকিটা সরকারের তহবিল থেকে খরচ হওয়ার কথা।
এ প্রকল্পগুলোর বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে দু’দফায় ভারতীয় হাইকমিশনকে অনুরোধ জানায় ইআরডি। গত বছরের ডিসেম্বর ও গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় দূতাবাসে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, অর্থছাড় বিলম্ব এবং বাস্তবায়ন ধীর হওয়ায় প্রকল্পগুলোর ব্যয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ পর্যায়ে বাস্তবায়ন কাজ শেষ করতে বাড়তি অর্থ প্রয়োজন। এ অর্থ পাওয়া না গেলে বিকল্প অর্থায়নের চিন্তা করতে হবে। তবে এখনও এ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ইআরডি সূত্র জানায়, বড় এ তিন প্রকল্পের বাইরেও অনেক প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজ বাদ দিতে চায় বাংলাদেশ। অর্থছাড় না হওয়ায় মূল কাজ যেখানে বন্ধ সেখানে বাড়তি অঙ্গের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আর দীর্ঘায়িত করতে চায় না সরকার।
সম্প্রতি কয়েকটি প্রকল্পের কিছু প্যাকেজ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে নতুন করে ভারতীয় হাইকমিশনকে চিঠি দেয় ইআরডি।
এ তালিকায় থাকা আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের বন্দর থেকে আশুগঞ্জ চৌরাস্তা পর্যন্ত ৬৫১ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ অংশ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় হাইকমিশনের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ (আরটিএইচডি) নিজস্ব অর্থায়নেই প্রকল্পের এ অংশের নির্মাণকাজ শেষ করতে চায়।
ভারতীয় এলওসির বিষয়টি দেখভাল করে ইআরডির এশিয়া উইং। এ উইংয়ের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাদ দেওয়ার জন্য এ রকম আরও প্রকল্প এবং বিভিন্ন প্রকল্পের প্যাকেজের কথা বিবেচনায় রয়েছে সরকারের।
তিনি বলেন, কখন একটি প্রকল্প বাদ দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ সেটা সবারই বোঝা দরকার। কিছু প্রকল্প যখন আর চলছে না, কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না– তখন সেগুলো বাস্তবায়নের তাগিদে এ পথে যেতে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, এলওসি প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত দুই দেশের কর্মকর্তাদের কয়েক দফা যৌথ বৈঠকে আলোচনা করে, কয়েক দফা চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েও এ ব্যাপারে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি গত বুধবার অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা বৈঠকটিও শেষ হয়েছে কোনো রকম অগ্রগতি ছাড়াই। আসলে কোনো পক্ষই আর এলওসির আওতায় প্রকল্প নিয়ে এগোতে চায় না। কারণ সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এর মধ্যে। এ ছাড়া এলওসির মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা করা ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল। ওই কৌশলের কারণেই এখন আর এ ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই।
যোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, কঠিন শর্তের এলওসি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। এর মাধ্যমে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। এখনও যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়নি, সেগুলো এক্ষুনি বন্ধ করা দরকার।
তিনি বলেন, যেসব প্রকল্প এরমধ্যে শেষ হয়েছে, সেগুলো কতটা মানসম্পন্ন, টেকসই এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উপযোগিতা রয়েছে কিনা, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার।
এর আগেও ভারতীয় এলওসির আওতায় বাস্তবায়নাধীন ছয়টি প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন, যশোর, কক্সবাজার, পাবনা ও নোয়াখালীতে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট পৃথক হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প। মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ‘সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো প্যাকেজটি বাদ দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু প্রকল্প বাদ দেওয়া হতে পারে। প্রকল্প পর্যালোচনা শেষে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইআরডি সূত্র জানায়, অর্থছাড় না করা, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের খবরদারিসহ নানা কারণে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীর। এলওসির শর্ত অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ সরঞ্জাম ও সেবা ভারত থেকে আনতে হয়। কিন্তু অনেক সরঞ্জাম ভারতে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও আবার মান ভালো হয় না অনেক ক্ষেত্রে। তাই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে চায় বাংলাদেশ। প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র প্রণয়ন, নকশা তৈরি ও দরপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। এসব প্রকল্পের লোকবলেরও একটা বড় অংশ ভারতীয় নাগরিক। এসব মেলাতে গিয়েই প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে না।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ। প্রকল্পগুলোর ভারতীয় ঠিকাদার ও কর্মীরা ওই সময় বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি। কয়েকজন ঢাকা এলেও নিরাপত্তার কারণে ভারতীয় হাইকমিশন তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। প্রকল্পে ভারতীয় কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ভারতীয় এলওসির প্রথম চুক্তি হয় ২০১০ সালে। ঋণের অর্থমূল্য ধরা হয় ৮৬ কোটি ডলার। দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি হয় ২০১৬ সালে। এতে অর্থমূল্য ধরা হয় ২০০ কোটি ডলার। তৃতীয় এলওসির চুক্তি হয় ২০১৭ সালে। অর্থমূল্য ধরা হয় ৪৫০ কোটি ডলার। অর্থাৎ মোট প্রস্তাবিত ঋণের পরিমাণ ৭৩৬ কোটি ডলার। এ পর্যন্ত এসব ঋণ চুক্তির আওতায় অর্থছাড় হয় ১৮৫ কোটি ডলারের মতো। এসব ঋণের সুদহার ১ শতাংশ ও প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। খেলাপি হলে ২ শতাংশ হারে সুদ ধার্য রয়েছে।
পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এরমধ্যে প্রথম এলওসির অর্থ পরিশোধ শুরু করেছে বাংলাদেশ। তিন এলওসির আওতায় মোট ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ১৫টির।