ঢাকা রবিবার, ০৯ মার্চ, ২০২৫

সাশ্রয় নেই জনপ্রশাসনে, খরচ বেড়েই চলেছে

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২৫, ১১:২৭ এএম
প্রতীকী ছবি

প্রতি বছরের বাজেটে জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ থাকে। এ বাবদ সরকারের প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণও বেশ বড়। প্রতি বছরই এ খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এর আগের বছরের তুলনায় জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিসহ সামনে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ্য ভাতা দেয়া হলে এর প্রভাবে বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৩১ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩০ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে বাজেটে মোট ৮১ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

সরকারি কোষাগারের অর্থ সাশ্রয়ের জন্য অর্থনৈতিক সংকটের মুখে থাকা দ্বীপদেশ শ্রীলংকা তাদের সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। এক্ষেত্রে দেশটির সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ১৩ লাখ থেকে কমিয়ে সাড়ে সাত লাখে নামিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা গত বছরের ডিসেম্বরে জানিয়েছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা দুমিন্দা হুলানগামুয়া। অবশ্য সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হলে সেক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ দক্ষতা নিশ্চিত করতে আকর্ষণীয় বেতন দেয়ার পরিকল্পনার কথাও জানানো হয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট ২০২৫ সালের বাজেটে দেশটির সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুরো জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। সরকারি কর্মকর্তারা নানা সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতির দাবিতে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ওপর নজিরবিহীনভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকলেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবি অপরিবর্তিত থাকে। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে কর্মচারীদের মহার্ঘ্য ভাতা দেয়ার আলোচনা শুরু হলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিগত সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে একের পর এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ১৭ জন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কর্মরত আছেন। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া একসঙ্গে ৭৬৪ জনের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তার বেতন-ভাতাসহ পেনশনের পাওনা টাকা পরিশোধে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারের ব্যয় আরও বাড়বে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৯৭৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট আটটি পে-স্কেল দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ২০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা দিয়েছিল সরকার। এর আওতায় সর্বোচ্চ ৬ হাজার আর সর্বনিম্ন ১ হাজার ৩০০ টাকা বেতন বেড়েছিল। তবে সে সময় বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড কর্তন করা হয়েছিল।

প্রতি বছর বেতন-ভাতা খাতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও এর পুরোটা ব্যয় হয় না। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রথমে এ খাতে ৮০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। যদিও পরে এ বরাদ্দ কমিয়ে ৭৭ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য সে অর্থবছরে এ অর্থের পুরোটা ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। আলোচ্য অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে সরকারের প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা।

বেতন-ভাতা খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ার বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস-উর রহমানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব-উল-আলম বলেন, আমাদের ব্যয় দুই ধরনের। একটি হলো আমাদের মাঠ প্রশাসন। উপজেলা থেকে শুরু করে অর্থাৎ ইউএনও অফিস, ডিসি অফিস, বিভাগীয় কমিশনারের অফিসগুলোয় আমরা বাজেট দিয়ে থাকি। এছাড়া আমাদের আটটি বিভাগ রয়েছে। গত বছরের তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে, নিয়োগ হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের খরচ কিছুটা বেড়েছে। গত বছর প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ছিল, এ বছর নতুন করে গতি বেড়েছে। আমাদের কেনাকাটাও আগের চেয়ে ভালো।

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের বাজেটে ব্যয় যেটা আছে, যদি সঠিকভাবে করা যায় তাহলে সেটি অর্থ বিভাগ সমর্থন করে। কারণ এর ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, মূলধনি ব্যয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি হয়। সঠিকভাবে ব্যয়টা হচ্ছে কি না সেটা আমরা কঠোরভাবে মনিটরিং করি। যে বাজেট থাকে সে অনুযায়ী ব্যয় সঠিকভাবে হলে সেটি জনপ্রশাসনের দক্ষতা। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা আছে, খালি পদগুলোয় নিয়োগ দিতে হবে। এ ছাড়া প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ব্যাপারও আছে। সবকিছু মিলিয়ে বাজেট অনুযায়ী ব্যয় হয় এবং সেগুলো সঠিকভাবে মনিটরিংও করা হয়।

গত এক দশকে জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ২৭ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছিল সরকার। এরপর এ খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৯৪৯ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৯ হাজার ৩১ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৮৪৭ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৩ হাজার ৪০০ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৬ হাজার ৯০৪ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৮ হাজার ৮৯১ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৩ হাজার ৩১৯ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৩ হাজার ৮৫০ কোটি এবং সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সরকারের।

তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা