জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং বিভিন্নভাবে সুবিধাভোগী প্রভাবশালী পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। ইতিমধ্যে অনেকে গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
দুর্নীতিবাজ এবং ছাত্র-জনতার হত্যাযজ্ঞে সরাসরি জড়িত হাসিনার দোসর পুলিশ সদস্যরা সরকারের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর এবং সীমান্ত দিয়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে তাদের একটি লম্বা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে পুলিশ সদর দপ্তর পাঠানো হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা তালিকাটি আরও অনুসন্ধান করে আরেকটি তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করে। ওই তালিকার মধ্যে ৪৬৭ জনের নাম এসবিসহ আরও দুটি গোয়েন্দা সংস্থায় পাঠানো হয়।
এই প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, তালিকার মধ্যে অন্তত একশজনের মতো দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে সবার বিষয়ে সব ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর ও সীমান্তে নজরদারি করা হচ্ছে। তবে অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হবে না। তালিকাভুক্ত কর্মকর্তারা ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ড, গুম ও খুন এবং রাতের বেলায় ভোট নেওয়ার অভিযোগ আছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতারাও নানা অপকর্মে সম্পৃক্ত।
সূত্র জানায় দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন- পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক, সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার লুৎফুল কবির, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন, সাবেক আইজিপি ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি, মীর রেজাউল আলম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, আইজিপি মো. আব্দুল বাতেন, ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র, সাবেক ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান, সাবেক ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান, সাবেক ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক, সাবেক ডিআইজি সরদার রকিবুল ইসলাম, সাবেক ডিআইজি মো. ইমাম হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল হামিদুল হক।
এ ছাড়া, ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সুপার ছিলেন ঢাকা জেলায় শাহ মিজান শাফিউর রহমান, গাজীপুরে শামসুন্নাহার, নারায়ণগঞ্জে হারুন অর রশীদ, নরসিংদীতে মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, মানিকগঞ্জে রিফাত রহমান শামীম, ফরিদপুরে জাকির হোসেন খান, শরীয়তপুরে আবদুল মোমেন, মাদারীপুরে সুব্রত কুমার হালদার, গোপালগঞ্জে সাইদুর রহমান খান, রাজবাড়ীতে আসমা সিদ্দিকা মিলি, কিশোরগঞ্জে মাশরুকুর রহমান খালেদ, টাঙ্গাইলে সঞ্জিত কুমার রায়সহ ওই সময়কার ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার, সবকটি রেঞ্জের ডিআইজি ও মহানগর পুলিশ কমিশনার।
একটি সূত্রমতে, ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ মারধরের শিকার হয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আবার অন্য একটি সূত্রমতে, তিনি অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালিয়েছেন।
জানা গেছে, ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার কথাও উঠেছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে কোনো এক সময় তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। পাচারকারীদের এ-সংক্রান্ত কয়েকটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্ত পার করার সময় বিপ্লব কুমারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেওয়া হয় বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমএইচ১০৩ এর একটি ফ্লাইটযোগে সিডনির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার নামে একাধিক মামলা হয়েছে। দুদকে তার নামে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অ্যাডমিন) হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও, অপারেশন শাখার দায়িত্বে এবং কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ ছাড়াও সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গত ২০ আগস্ট ব্যাংককের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগের জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। কিন্তু ডিবিকে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জানানো হলে খন্দকার গোলাম ফারুকের দেশ ত্যাগের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়। পরে অবশ্য তিনি বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরে যান। খন্দকার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে।