বাংলাদেশে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন চায় ভারত, কিন্তু কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৫, ১০:৫২ এএম

বাংলাদেশে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন চায় ভারত, কিন্তু কেন?

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ভারতের উদ্বেগ বাড়ছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে, যেখানে সব পক্ষ গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।  

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ মাস আগে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, এরপর থেকেই নয়াদিল্লি স্পষ্টভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে।

শুক্রবার (৮ মার্চ) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে স্থিতিশীলতা, শান্তি ও গণতন্ত্র থাকবে। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন জরুরি।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

গত আগস্টে শেখ হাসিনা রাজপথের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে অন্তর্বর্তী সরকার। তখন থেকেই বাংলাদেশ টালমাটাল। তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেয়ার দাবি জোরালো থেকে আরও জোরালো হচ্ছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এই সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। 

আগামী ডিসেম্বর  থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের একটি টাইমফ্রেম ঘোষণা করেছেন ড. ইউনূস। তবে কোনো রোডম্যাপের বিষয়ে জোর দেননি। কিছু কিছু তরুণ নেতা- যারা নিজেদের ছাত্র বলে দাবি করেন এবং ড. ইউনূসের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে, তারা বলছেন নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংস্কার হওয়া উচিত। বারবার তাদের এমন দাবির ফলে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। 

জামায়াতে ইসলামী এবং নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর থেকে বেরিয়ে আসা এমন কিছু তরুণ নেতা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দাবি করেন। তাদের একজন সারজিস আলম। তিনি নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার বিচার করে তার ফাঁসি দাবি করেছেন। ফলে নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এখন রাজনৈতিক এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের নির্বাচন তদারকি করার ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট আছে কি না তাও প্রশ্ন।

শেখ হাসিনার দলের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্বেষ আছে। দেশ জুড়ে এ দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে যে দমনপীড়ন চলছে, তাতে সেই বিদ্বেষ প্রতিফলিত হয়। ফলে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করছেন নির্বাচন হওয়া উচিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানিয়া আমির বলেন, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে অন্তর্বর্তী সরকারকে শপথ পড়ানো হয়েছিল। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আছে।

 অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া উচিত। জেল থেকে যেসব অভিযুক্ত সন্ত্রাসী মুক্তি পেয়েছেন সারা দেশে তাদের গ্রেপ্তারের পক্ষে পরামর্শ দিয়েছেন তানিয়া আমির। 

ভারতের উদ্বেগ ও বার্তা

রণধীর জয়সওয়াল বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশ করেছেন, যেখানে সব রকমের অপরাধ, বিশেষ করে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে আমরা উদ্বিগ্ন। গুরুতর অপরাধের জন্য সাজা হয়েছিল এমন ভয়াবহ উগ্রপন্থিদের মুক্তি দেয়ার কারণে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহভাবে বেড়েছে।

সম্প্রতি বিবিসিকে ড. ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে অপরাধের হার বৃদ্ধি পায়নি। তার এই যুক্তির খণ্ডন হিসেবে দেখা যেতে পারে রণধীর জয়সওয়ালের বক্তব্য। 

ড. ইউনূসের প্রতি নমনীয় ঢাকার এমন একটি প্রকাশনা সম্প্রতি পুলিশের রিপোর্ট উল্লেখ করে বলেছে, গত ছয় মাসে বাংলাদেশে ডাকাতি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, বেশির ভাগ অপরাধের রিপোর্ট করা হয় না। ফলে এর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।

ড. ইউনূস দাবি করেছেন, তার সরকার আসার পর বাংলাদেশে অপরাধের হার বাড়েনি। কিন্তু বিবিসি-তে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে ডাকাতির হার ৫০% বেড়েছে।

 পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রকৃত অপরাধের সংখ্যা আরও বেশি, কারণ অনেক ঘটনাই রিপোর্ট করা হয় না।

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক সংখ্যালঘু সুরক্ষা।

জয়সওয়াল বলেন, হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব। তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তি রক্ষা করাও জরুরি। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ২,৩৭৪টি সহিংস ঘটনার মধ্যে মাত্র ১,২৫৪টি আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯৮% ঘটনা রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারত আশা করে, এই সহিংসতার পূর্ণ তদন্ত হবে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

গত ৬ মার্চ কলকাতায় গঙ্গা পানি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমিটির ৮৬তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জয়সওয়াল জানান, দুই দেশ পানিপ্রবাহ পরিমাপ ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়েছে নয়াদিল্লি, যা শেখ হাসিনার দলের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে ভারত কড়া নজর রাখছে।

আগামী দিনে ড. ইউনূস সরকার কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ সামলায়, তার ওপরই নির্ভর করবে ভারতের ভবিষ্যৎ অবস্থান ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ।

তথ্যসূত্র:  ডেইলি টেলিগ্রাফ

আরবি/এসবি

Link copied!