একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্বাধীনতার আন্দোলন দিনে দিনে গতি পাচ্ছিল; জোরালো হচ্ছিল বাঙালির আত্মবিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই কার্যত চলছিল পূর্ব পাকিস্তান। ঘরে ঘরে উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত নতুন পতাকা।
এদিকে অসহযোগ আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১০ মার্চ সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা তোলা হয়। এমনকি প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসেও এদিন কালো পতাকা ওড়ে।
দেশে সরকারি ও আধা সরকারি অফিসের কর্মচারীরা দশম দিনের মতো কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। জরুরি কাজের বিবেচনায় বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও ব্যবসাকেন্দ্র খোলা থাকে।
একাত্তরের এই দিন সকালে বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিকেলে ওয়ালী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলার দাবিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা হয়। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। ‘লেখক-শিল্পী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের’ ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন।
নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ করেন। তারা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা বন্ধে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে মহাসচিব উ-থান্টের কাছে স্মারকলিপি দেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। সামরিক সজ্জা অব্যাহত রেখে বাংলার বুকে এক জরুরি অবস্থা কায়েম রাখার প্রয়াসী।
করাচিতে ন্যাপপ্রধান ওয়ালী খান সাংবাদিকদের জানান, তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য ১৩ মার্চ ঢাকায় যাবেন। ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায়, সে জন্য আগে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করবেন।
করাচি থেকে বঙ্গবন্ধুকে টেলিগ্রাম/টেলিফোন বার্তায় আপসে বসার আহ্বান জানান এয়ার মার্শাল আসগর খান। তিনি বলেন, পরিস্থিতি যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে; সেনানিবাস পাকিস্তানের পতাকার মর্যাদা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এদিন জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা যেকোনো সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামে বাস্তবায়নের সংকল্প জানায় পরিষদ।
১৯৭১ সালের ১০ মার্চ ছিল আরও একটি উত্তাল দিন। বিক্ষুব্ধ বাংলায় বিদ্রোহ-বিক্ষোভের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন চলছিল তখন। বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেয় এই দিনে।
১১ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ১০ মার্চের প্রধান খবরগুলো প্রকাশ করা হয়। নতুন করে কারা প্রতিরোধে শামিল হলো সেটাও উল্লেখ ছিল খবরে। সংবাদে বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতাসংগ্রামে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সকল প্রকার সাহায্য করার অনুরোধ জানানো হয়।
পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের আসতে না দিলে বিমানবন্দরে চেকপোস্ট বসিয়ে অবাঙালিদের দেশত্যাগ করতে না দেওয়ার হুমকি নিয়েও সংবাদ প্রকাশিত হয়। একাত্তরের এই দিন সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজ বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, সাত কোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যেকোনো মূল্যে তারা অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করতে চাই।
ঢাকায় এই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের নামে আমি যে নির্দেশ দিয়েছি, সচিবালয়সহ সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস-আদালত, রেলওয়ে ও বন্দরগুলোতে তা পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তার বিবৃতিতে আরও বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত।