২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমান একটি আদর্শের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ওই সময় বিমানের প্রতিটি কাজের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিমানের বোর্ড পুনর্গঠিত হলেও কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবের অভিযোগ উঠেছে।
কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলেও তাকে সেই দোষমুক্ত করার জন্য পছন্দের লোক দিয়ে গঠন করা হচ্ছে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি। গত ১৫ বছরে যাদের দোর্দন্ড প্রতাপে বিমানের ‘ভেঙে পড়ার’ উপক্রম হয়েছিল, তারাই নানা জায়গায় পুনর্বাসিত হচ্ছেন। গাড়িচালক থেকে শুরু করে বিমানচালকও অনিয়মে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ। বলা যায়, নৈরাজ্যের আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ‘বিমান’।
বিমানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিমানের নিজস্ব কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিমানের প্রায় সবাইকেই চেনেন। তিনি যেসব কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারবেন, প্রশাসন ক্যাডার থেকে এমডি এনে সে কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার কর্মকান্ডে বিমানকর্মীরা নাখোশ। তিনি তেলা মাথায় তেল ঢালছেন। বিগত বছরগুলোয় যারা সুবিধা ভোগ করেছেন, তাদেরই সুবিধাজনক জায়গায় চাকরি করার সুযোগ দিচ্ছেন। সার্টিফিকেট জালিয়াতি, তেল চুরির মতো ছোটখাটো ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় বিমানে অসন্তোষের আলামত পাওয়া যাচ্ছে।
গত ১৫ বছর যারা বিমানে দাপট দেখিয়েছেন, বর্তমান প্রশাসন তাদের প্রতি নমনীয়। নানা অনিয়মে জড়ানোর কারণে বিমান শ্রমিক লীগের ১৭ নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন বিমানের সিবিএর সভাপতি মশিকুর রহমান। তাকে সম্প্রতি টরন্টো থেকে প্রত্যাহার করা হলেও তিনি সপরিবারে টরন্টোতেই আছেন। বর্তমান এমডি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। ওই ১৭ জনের সিন্ডিকেটের বাকিদের যারা চাকরিতে আছেন, তারাও নানা সুবিধা নিচ্ছেন বর্তমান ব্যবস্থাপনার কাছ থেকে। সাবেক সিবিএর বাইরেও শ্রমিক লীগের অন্য নেতারা নানাভাবে সুবিধা নিচ্ছেন।
বিমানে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যারা সরকারি চাকরি করেও রাজনৈতিক পদ-পদবির মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বিস্তার করছেন। বাংলাদেশ বিমান এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি এটিএম সাজ্জাদুল আলমকে জুনিয়র অফিসার থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তিনি বিগত সময়ে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ভিভিআইপি, ভিআইপি, মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের এয়ারপোর্টে প্রটোকল দেওয়ায় ব্যস্ত থেকেছেন।
শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় ও বিমান ইউনিটের নেতা মো. রফিকুল আলম জুনিয়র অফিসার থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে, মো. হারুনর রশিদ জুনিয়র অফিসার (প্রশাসন) থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন), মো. দলিলুর রহমান জুনিয়র অফিসার থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশাসন পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ৫ আগস্টের আগে দাপিয়ে বেড়ানো শ্রমিক লীগ নেতা মো. আতিকুর রহমান এবং মো. ফিরোজুল ইসলামকে (অডিট) বিধিবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিমানের যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার স্টেশনের জুনিয়র অফিসার থেকে মো. আতিকুর রহমানকে সহকারী ব্যবস্থাপক (অ্যাকাউন্টস) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফিরোজুল ইসলামকেও একই পদে পদোন্নতি নিয়ে বিমান হেডকোয়ার্টার বলাকায় নেওয়া হয়েছে। ফিরোজুল ইসলামের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভোল পাল্টানোর অভিযোগও রয়েছে। গত ১৫ বছরের সুবিধাবাদী গোলাম কায়সার আহমেদকে জুনিয়র অফিসার (বাণিজ্যিক) থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে, বিমান শ্রমিক লীগের প্রশাসন শাখার সভাপতি মো. আবু সাইদের জুনিয়র অফিসার (প্রশাসন) থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদে পদোন্নতি হয়েছে।
অন্যদিকে, শ্রমিক লীগের ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট শাখার সভাপতি মো. আলমগীর হোসেনকে জুনিয়র অফিসার (ম্যাটেরিয়াল) থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক (ম্যাটেরিয়াল) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রকিউরমেন্ট শাখা শ্রমিক লীগের সভাপতি ফরিদপুরবাসী মো. শরিফুল ইসলামকে কয়েকজনকে ডিঙিয়ে জুনিয়র অফিসার (প্রকিউরমেন্ট) থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের লোকদের বিদেশ পোস্টিংয়ে নানা অনিয়ম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিমানে বিদ্যমান তিন বছরের বাধ্যবাধকতা মানা হয়নি। বৈদেশিক স্টেশনে তিন বছর হয়ে গেলে তাকে প্রত্যাহার করার নিয়ম রয়েছে। বিগত বছরগুলোয় সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তাকে ফেরত না এনে অন্য স্টেশনে পদায়নের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
এএফএম আনিসুর রহমান ২০২১ সাল থেকে বিমানের কাঠমান্ডু শাখায় কর্মরত। আব্দুল্লাহ আল হুসাইন উপব্যবস্থাপক হিসেবে ২০২১ সাল থেকে আবুধাবিতে ছিলেন। গত সরকারের সুবিধাভোগী এ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে ইতালির রোমে পদায়ন করেছে বর্তমান ব্যবস্থাপনা। মো. মেসবাহ উদ্দিন ২০২০ সাল থেকে প্রায় পাঁচ বছর দিল্লিতেই কান্ট্রি ম্যানেজার ছিলেন। বর্তমান ব্যবস্থাপনা তাকে দিল্লি থেকে টরন্টোতে পোস্টিং দিয়েছে। কান্ট্রি ম্যানেজার করে শরীফুল আলমকে ২০২১ সালে মাস্কাটে পাঠানো হয়। বর্তমান ব্যবস্থাপনা তাকে সেখানে রেখেই গ্রুপ ৭ থেকে গ্রুপ ৮-এ পদোন্নতি দিয়েছে। তাকে দেশে ফেরত না এনে দুবাইয়ে পদায়ন করা হয়েছে। ২০২২ কুয়ালালামপুরের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে পদায়ন করা হয় রিয়াদ সোলায়মানকে। তাকে কুয়ালালামপুর থেকে লন্ডনে পদায়ন করা হয়েছে। এ বি সিদ্দিক ২০২২ সাল থেকে কুয়েতের কান্ট্রি ম্যানেজার। জ্যেষ্ঠতা থাকার পরও তাকে অন্যত্র পদায়ন করা হয়নি। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুর রহমানকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি।