সম্প্রতি দেশে ক্রমেই বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেও এর রাশ টানা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতির নেপথ্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসররা।
সূত্র বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে কর্মরতদের বেশির ভাগই আওয়ামী শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত। ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানে দেশে পট পরিবর্তন হলেও তারা ঘাপটি মেরে থেকে নেপথ্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে কীভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যায়। সম্প্রতি দেশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, পুলিশে সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার যে ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে এরই মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
কমিশনের প্রস্তাব কার্যকর হলে পুলিশ বাহিনী অনেকটাই সংশোধন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক এ গণঅভ্যুত্থানের পর অত্যন্ত ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো থিতু হয়নি চলমান অস্থিরতা। চলমান পরিস্থিতির নেপথ্যে আওয়ামী দোসর হিসেবে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পতিত সরকারের পালিয়ে যাওয়া দোসররা নানাভাবে উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন, যা কার্যকর করার চেষ্টা করছে দেশে অবস্থানরতদের।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. উমর ফারুক বলেন, অধিকাংশ পুলিশ যেহেতু ওই সরকরের সময় নিয়োগ পেয়েছে, ফলে অধিকাংশ পুলিশ দমন-পীড়নে সক্রিয় ছিল। ফলে তারা পারস্পরিক এবং নিজের ওপর নিজেদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ, হামলা, মামলা, বদলি এবং ওএসডির মতো আতঙ্কে আছে। তারা নিজেরা নিজেদের নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে।
সূত্র জানায়, পুলিশ এখনো নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পুলিশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বদলির জন্য অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘কানভারী করার’ অভিযোগ পাওয়া গেছে। পোস্টিং প্রতিযোগিতার কারণে নিজ কর্মস্থলে শতভাগ মনোযোগী হয়ে কাজ করছেন না পুলিশ সদস্যরা। আবার কিছু কর্মকর্তা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ মেলাচ্ছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা ভেবেছেন নির্বাচিত সরকার এলে তারা জোরেশোরে কাজ করবেন। এতে পুলিশের কর্মকাণ্ড কমে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে সারা দেশে ২৯৪ জন খুন হয়েছেন। এ সময় নিপীড়নের শিকার হয়েছে এক হাজার ৪৪০ নারী-শিশু। একই সময়ে ১০৫টি অপহরণ, ৭১টি ডাকাতি ও ১৭১টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে খুন হয়েছে ৯৪৭ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি সংকট একই সঙ্গে কোনো না কোনো সুযোগের জন্ম দেয়। সম্প্রতি পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পদক্ষেপ। তবে এখানেই থামলে চলবে না। দীর্ঘস্থায়ী, রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের জন্য সামনে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে পুলিশিংয়ে এমন পরিবর্তন ত্বরান্বিত করতে হবে, যাতে বাহিনীর সংস্কৃতি, আচরণ, কাঠামো এবং আইনেও বদল আসে। পুলিশ বাহিনীর বর্তমান অবস্থা আর চলতে পারে না।
এদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পুলিশকে বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে আরও সক্রিয় করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করায় সারা দেশে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এর ফলে পুলিশের কিছু সদস্য ট্রমায় ভুগছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুলিশকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ, মোটিভেশনাল ট্রেনিং দেওয়া ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একজন ডিসি বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশের কয়েকটি ঘটনায় কাজে স্পৃহা পাচ্ছেন না তারা। সাবেক আইজিপিসহ একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের নামে মামলা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশের একটি অংশ কাজ করছে না। তাদের অনুমান, বাড়তি কাজ করতে গেলে তার বিরুদ্ধে পরের সরকার অ্যাকশন নিতে পারে। পুলিশের একটি অংশ রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে।