সম্প্রতি বাংলাদেশে একাধিক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। বিশেষত, ঢাকা শহর মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ এটি অপরিকল্পিত নগরায়ণের শিকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি মাত্র ১ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে, এবং ৫-৭ লাখ মানুষ ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচে আটকে পড়তে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা দেশটিকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে, বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে প্রবেশ করছে, যা ‘সাবডাকশন জোন’ তৈরি করছে।
এ বিষয়ে গবেষক আক্তারুল আহসান বলেন, ‘বাংলাদেশকে আমরা জিওলজির ভাষায় ‘বেঙ্গল বেসিন’ বলে থাকি। এর মধ্যে পুরো বাংলাদেশসহ ভারতের কিছু অংশ এবং মিয়ানমারের কিছু অংশ রয়েছে। আমাদের নর্থ-ইস্টার্ন পার্ট বা ভারতের মেঘালয়ের সঙ্গে যেখানে আমাদের সীমানা, সেখানে ‘ডাউকি ফল্ট’ নামে একটা ফল্ট আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে ১৮৯৭ সালে মেঘালয় সীমান্তে ৮ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। সেটা আমরা সরেজমিনে গিয়েও তার প্রমাণ পেয়েছি। এ ছাড়া সিলেট-শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে ১৯১৮ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশদের বাংলো ও ক্লাবঘরগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। তা ছাড়া ১৮৮৫ মানিকগঞ্জের কাছে যমুনা নদীর কাছাকাছি ভূমিকম্প হয়। ওটা তখন মাপা হয়নি তবে, পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে ওটা ৭ এর ওপরে ভূমিকম্প ছিল। আনুমানিক ৭ দশমিক ৬ বা ৮ মাত্রার ছিল। ’
প্রতি বছর এই প্লেটগুলো ১ থেকে ১.৫ মিটার সংকুচিত হচ্ছে, যার ফলে এখানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। এই ভূমিকম্প যেকোনো সময় ঘটতে পারে, যা ভয়াবহ প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
ঢাকা শহরের বিশেষ ঝুঁকি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানিয়েছেন, ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন-
- অপরিকল্পিত নগরায়ণ: অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়।
- নির্মাণ কোড অনুসরণ না করা: অনেক স্থাপনা দুর্বল ও ভূমিকম্প সহনশীল নয়।
- উদ্ধার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: ভূমিকম্পের পর দ্রুত উদ্ধার অভিযান চালানোর মতো পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও জনবল নেই।
তার মতে, প্রাথমিকভাবে ২ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে এবং খাদ্যাভাব, অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
সরকারি প্রস্তুতি ও দুর্বলতা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক নিতাই চন্দ্র দে সরকার জানিয়েছেন, সরকার ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রস্তুতির ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে।
মূল সমস্যা:
- ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রকৃত প্রস্তুতির অভাব
- উদ্ধার কার্যক্রমের চেয়ে সরঞ্জাম কেনাকাটায় বেশি মনোযোগ
- অগ্নিনির্বাপন ও মেডিকেল ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা
কী করা উচিত?
• নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে
• জরুরি উদ্ধার পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে
• সাধারণ মানুষকে ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে
• উন্নত অনুসন্ধান ও উদ্ধার সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হবে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।