দুর্নীতির বরপুত্র তাকসিম

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৫, ১০:৫০ এএম

দুর্নীতির বরপুত্র তাকসিম

ছবি: সংগৃহীত

বিগত ১৫ বছরে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান । ওয়াসার বড় বড় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি জানার পরও শেখ হাসিনা বরাবরই শুধু নীরবই থাকেননি, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত দফায় দফায় এমডি পদে তার মেয়াদ বাড়ান সাতবার।

২০২৩ সালের আগস্টে  ৭ম বারের মতো এমডি পদে আরও  ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও  দেশ ছাড়তে পারেননি তাকসিম। ভঙ্গুর ও ঋণগ্রস্ত ওয়াসাকে ফেলে অনলাইনে পদত্যাগ করে রীতিমতো আত্মগোপনে চলে যান তিনি। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে।

অর্থ পাচার, নিয়োগ-বাণিজ্য, বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অন্যান্য খাতে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ওয়াসার সাবেক এই এমডির বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে  চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে তাকসিম এ খানসহ বোর্ডের ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।

মামলায় বলা হয়েছে, ওয়াসার সাবেক পরিচালক আবুল কাশেম ও এ কে এম সহিদ উদ্দিনের নিয়োগ প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেন আসামিরা। পাশাপাশি তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮০ টাকা আত্মসাতের

সহযোগিতা করেন। ওয়াসার সাবেক পরিচালক আবুল কাশেম অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিস্বার্থে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পরস্পর যোগসাজশে অনিয়ম–দুর্নীতির মাধ্যমে পরিচালক (উন্নয়ন) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বেতন-ভাতাদি বাবদ ৯৯ লাখ ৫২ হাজার ২৭১ টাকা আত্মসাৎ করেন। অন্যদিকে, এ কে এম সহিদ উদ্দিনও বেতন-ভাতাদি বাবদ ৯৯ লাখ ৫২ হাজার ২৭১ টাকা আত্মসাৎ করেন।

দুদক সূত্রের দাবি, মামলা দায়েরের পর তদন্ত দল পরিবর্তন হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতিবাজদের সেই চেষ্টা থাকতেই পারে। এরপরও এ সময়ে অভিযোগের তদন্ত হবে সঠিকভাবেই বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে, রাজধানীর মুগদায় আবদুল বাছেদ শামীম নামে এক আইনজীবীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাকসিম এ খানসহ ৫৯ জনের নামে মামলা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা সরকারকে লেখা এক চিঠিতে অভিযোগ করেন, পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা ।

তাদের অভিযোগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিতাড়িত শেখ হাসিনার আত্মীয় বলে তিনি আইনকে পরোয়া না করে যা খুশি তাই করেছেন। অন্যায়ভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত করেছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে দেননি  অনেককে।

সংশ্লিষ্টরা জানান,  অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসাকে তিনি রুগন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন তাকসিম এ খান। তিনি এতই ক্ষমতাধর ছিলেন যে, দেশের কোনো আইন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও তার কিছুই করতে পারেনি। অভিযোগের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলেও শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রশ্রয়ে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ওয়াসাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন তিনি । বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রকল্পের নামে ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। বিগত সরকারের দোসরদের সঙ্গে মিলেমিশে লুটপাট চালিয়েছেন তিনি। শত শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার মেয়াদে। কিন্তু নগরবাসী এসব প্রকল্প থেকে সুবিধা পাননি। উল্টো পানি ও পয়ঃসেবার দাম বাড়িয়ে দুর্ভোগে ফেলেছেন রাজধানীবাসীকে। ২০০৯ সালের পর থেকে ১৬ বার ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ান তিনি।  বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে সংস্থাটি প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিমের মাসিক বেতন ছিল ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে একলাফে ওয়াসার এমডির বেতন পৌনে দুই লাখ টাকা বাড়ানো হয়।

২০০৯ সালে তাকসিম যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে যোগ দেন। তার পরিবারের সব সদস্যই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তাকসিমের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বিভিন্ন সূত্রে  জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে  বিভিন্ন শহরে ১৪ বাড়ি রয়েছে তাকসিম এ খানের। যার মধ্যে পাঁচটির তথ্য মিলেছে।  ৪১৯, ই সাইপ্রেস অ্যাভিনিউ বারব্যাংক, সিএ ৯১৫০১ এ ঠিকানায় ২০১৭ সালে ১৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৯ ডলারে (সে সময়ের দরে আনুমানিক ১৭ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১৪টি বেডরুম ও ১৪টি বাথরুম। ৫১৮, সেলেম স্ট্রিট গ্লেনডেল, সিএ ৯১২০৩- এই ঠিকানায় ২০১৮ সালের আগস্টে ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৪ ডলারে (আনুমানিক ৩৭ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ছয়টি বেডরুম ও ছয়টি বাথরুম। ৩৫০ ই ৩০তম স্ট্রিট নিউইয়র্ক, সিএ ১০০১৬-৮৩৮৬- এই ঠিকানায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৬১৪ ডলারে (আনুমানিক ৫৩৫ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১০২টি বেডরুম ও ১০২টি বাথরুম। ৩৫৫৫ কাইসস্টোন অ্যাভিনিউ লস অ্যাঞ্জেলস, সিএ ৯০০৩৪- এই ঠিকানায় ২০১৯ সালের অক্টোবরে ৮২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮০ ডলারে (আনুমানিক ৭০ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১২টি বেডরুম ও ১২টি বাথরুম। বাড়িগুলো তাকসিম ভাড়া দিয়ে রেখেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদ থাকলেও দেশে কোনো সম্পত্তি নেই তাকসিমের। গুলশান-২ এর ৫৫ নম্বর সড়কে সরকারি বাসভবনে বসবাস না করে নয়াপল্টনে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন তিনি।

আরবি/এসবি

Link copied!