এক ট্রেন ধুতেই ব্যয় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা!

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম

এক ট্রেন ধুতেই ব্যয় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা!

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেন ধোয়ার জন্য ৩৮ কোটি টাকায় দুটি স্বয়ংক্রিয় ধৌতকরণ ব্যবস্থা বা ওয়াশিং প্ল্যান্ট কিনেছিল। একটি স্থাপন করা হয় ঢাকার কমলাপুরে, অন্যটি রাজশাহীতে। ২০ মাসের মাথায় প্ল্যান্ট দুটি বন্ধ হয়ে যায়।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, দুটি প্ল্যান্ট দিয়ে ২ হাজার ৯২৯ বার ট্রেন ধোয়া সম্ভব হয়েছিল। হিসাব করে দেখা যায়, প্ল্যান্ট দুটি স্থাপনে যে ব্যয় হয়েছে, তাতে প্রতিটি ট্রেন ধোয়ার পেছনে সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। প্রচলিত ব্যবস্থায় হাতে ট্রেন ধুতে খরচ হয় ১ হাজার টাকার মতো।

ওয়াশিং প্ল্যান্ট নামে যে ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল, তাতে মূলত কিছু স্বয়ংক্রিয় ব্রাশ, সাবান পানি ও সাধারণ পানি ছিটানোর ব্যবস্থা এবং কয়েকটি বৈদ্যুতিক পাখা ছিল। সাধারণ এই ব্যবস্থা তৈরিতে এত ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল তখনই। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক দিন ধরে প্ল্যান্ট দুটি বন্ধ। সেগুলো পুনরায় চালু করতে আরও বিনিয়োগ দরকার, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।

প্ল্যান্ট দুটি চালানো হতো বিদ্যুতের সাহায্যে। ট্রেন ধোয়ার কাজে পানি ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা হতো। এর পরিচালনায় থাকা লোকবলসহ সব খরচ ধরলে প্রতিটি ট্রেন ধোয়ার পেছনে দেড় লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। রেলওয়ে সব সময় চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক দিয়ে ট্রেন ধোয়ার কাজ করে থাকে। শ্রমিক, পানির ব্যবহারসহ সামগ্রিকভাবে একটি ট্রেন ধোয়ার পেছনে এক হাজার টাকাও খরচ হয় না। অন্যদিকে ওয়াশিং প্ল্যান্ট দুটি কেনা হয়েছিল কোচ কেনার একটি প্রকল্পের আওতায়। রেলের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার মত, শুধু প্রকল্প বড় করার জন্যই এই যন্ত্র কেনা হয়েছিল। রেলের কিছু কর্মকর্তা এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর আগ্রহে যন্ত্র দুটি কেনা হয়।

চট্টগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী দুই মেয়াদে রেলপথ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। ওয়াশিং প্ল্যান্ট সরবরাহে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রতিনিধির পক্ষে ফজলে করিম কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফজলে করিম চৌধুরী এখন কারাগারে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই বিদেশি ঋণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় রেলের বার্ষিক লোকসান ছিল ৬৯১ কোটি টাকা। এরপরই নতুন রেললাইন নির্মাণসহ নানা প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ শুরু করে সরকার। বাড়ানো হয় ভাড়া। এরপরও বাড়তে থাকে লোকসান। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। লোকসান ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক টাকা আয় করতে রেল দুই টাকার মতো ব্যয় করছে।

ওয়াশিং প্ল্যান্ট দুটির যন্ত্রপাতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হয়েছিল। এই যন্ত্রের কার্যকারিতা দেখতে ২০১৯ সালে তিনজন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এর মধ্যে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি রোলিং স্টক) সৈয়দ ফারুক আহমেদ যন্ত্র কেনার কিছুদিন পরই অবসরে যান। প্রকল্প পরিচালক ফকির মো. মহিউদ্দিন এখনো রেলে কর্মরত। তিনি এখন ২০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন ও ১৫০টি মিটারগেজ কোচ কেনার প্রকল্পের পরিচালক। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফকির মো. মহিউদ্দিন রেলওয়েতে বৈষম্যবিরোধী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করে এর মুখ্য সমন্বয়ক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করা আরেকজন হচ্ছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব মাহাবুবুল হক।

রেলওয়েতে রক্ষিত দুটি ওয়াশিং প্ল্যান্ট পরিচালনাসংক্রান্ত তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের নভেম্বরে ওয়াশিং প্ল্যান্টগুলো ঘটা করে উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। ঢাকার প্ল্যান্টটি ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত মোটামুটি চালু ছিল। এরপরই সমস্যা শুরু হয়। গত বছর মে মাসে মাত্র দুটি ট্রেন ধোয়া হয়। এরপর এর কোনো ব্যবহার হচ্ছে না।

রাজশাহীর প্ল্যান্টটি গত বছর এপ্রিল পর্যন্ত চালু ছিল। এ সময় মাসে গড়ে ৮টি ট্রেন ধোয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ঢাকার প্ল্যান্টটিতে ২ হাজার ৬৮৯টি এবং রাজশাহীর প্ল্যান্টে ২৪০টি ট্রেন ধোয়া হয়। দুই প্ল্যান্টে ধোয়া কোচের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৯৬২টি। অর্থাৎ প্রতিটি কোচ বা কামরা ধোয়ার পেছনে গড়ে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ১২৪ টাকা।

কমলাপুরে গিয়ে দেখা যায়, ওয়াশিং প্ল্যান্টটিতে ধুলা পড়ে গেছে। ওয়াশিং প্ল্যান্টে প্রবেশের মুখে অন্য ট্রেন রেখে দেওয়া হয়েছে। এখানে আর কোনো কর্মকাণ্ড হয় না। পাশের সারি সারি লাইনে পুরোনো পদ্ধতিতে শ্রমিকদের ট্রেন ধোয়ার কাজ করতে দেখা গেছে।

ট্রেন ধোয়ার কাজে যুক্ত একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যত দিন ওয়াশিং প্ল্যান্ট চালু ছিল, সেখানে ট্রেন ধোয়ার পর পুনরায় শ্রমিকদের পরিষ্কার করতে হতো। কারণ, ওয়াশিং প্ল্যান্টে ট্রেনের ভেতরে পরিষ্কার করা হতো না। শুধু বাইরের অংশ ধোয়া হতো। যন্ত্র দিয়ে ট্রেন ধোয়ার পরে পানের পিক, চুইংগামসহ কোচের গায়ে লেগে থাকা অন্যান্য দাগ ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হতো। ট্রেনের ভেতর ও শৌচাগারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হয় পুরোনো পদ্ধতিতেই।

আরবি/এসবি

Link copied!