ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছিল

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৫, ১০:২০ এএম

ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছিল

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের সপ্তদশ দিনে বাংলার চলমান অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এ বৈঠকে মিলিত হন। কড়া সামরিক প্রহরার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে এই বৈঠক শুরু হয়। 

এদিন প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক চলে। আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি। তবে পরবর্তী বৈঠকের তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও আসে এই দিনেই। 

জনগণকে ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানানো হয়। এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু নিজের বাসভবনে গেলে একজন সাংবাদিক জানতে চান বৈঠক সংক্ষিপ্ত হলো কেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু মৃদু হাসেন। আরেক বিদেশি সাংবাদিক বলেন, ‘এই হাসি থেকে আমরা কী কিছু অনুমান করে নিতে পারি?’

জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আপনার মুখেও তো মৃদু হাসি। আমি জাহান্নামে বসেও হাসতে পারি।’ ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বঙ্গবন্ধু সন্তুষ্ট কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো বলেছি নরকে বসেও আমার চিত্তে সুখের অভাব হবে না। আমার চেয়ে বেশি সুখী আর কে আছে? সাত কোটি মানুষ আজ আমার পেছনে পাহাড়ের মতো অটল। আমার জনগণ যা দিয়েছে তার তুলনা নেই।’

১৮ মার্চের দৈনিক সংবাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশগামী সব বিদেশি বিমানের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানগামী সব বিমানকে ভারতে একবার অবতরণ করতে বলা হয়েছে। বিদেশি বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা বহন করে পূর্ব পাকিস্তানে নেওয়া রোধ করতে ভারত সরকার এমন ব্যবস্থা নেয়।

অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ উপলক্ষে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা ওই দিন সকাল ৬টায় সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সব ধরনের যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরি, শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র-জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে।

১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। একাত্তরের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন উপলক্ষে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মিছিল করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে গিয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানায়।

এই দিনেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানের। জন্মদিনে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা জন্মদিনই কি আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা আমার জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে।’

সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘পূর্ববাংলা এখন স্বাধীন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। আমার ৮৯ বছরের অতীতের সবকটি আন্দোলনের সাথে আমি জড়িত ছিলাম। কিন্তু একটি সর্বজনীন দাবিতে জনগণের মধ্যে বর্তমান সময়ের মতো একতা ও সহযোগিতা আমি এর আগে কখনো দেখিনি।

অসহযোগ আন্দোলনের ষোড়শ দিবসে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকেরা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ভুট্টোর দুই অংশের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ নির্বাচন গোটা দেশের জন্য হয়েছে। দুই অংশের জন্য পৃথক পৃথক নির্বাচন হয়নি। কাজেই জাতীয় পরিষদে একটি মাত্র মেজরিটি পার্টি থাকবে। ভুট্টোর প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।

স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে প্রতিরোধ দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ওই দিন সরকারি-বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান।
 

আরবি/এসএম

Link copied!