করোনা টিকার ২২ হাজার কোটি টাকা সালমান সিন্ডিকেটের পেটে!

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৫, ০৯:৪৫ পিএম

করোনা টিকার ২২ হাজার কোটি টাকা সালমান সিন্ডিকেটের পেটে!

ছবি : রূপালী বাংলাদেশ।

করোনাভাইরাসের টিকা কেনার নামে রাষ্ট্রের ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের ইশারায় আটকে যায় বাংলাদেশ আবিষ্কৃত করোনা ভ্যাকসিন বঙ্গভ্যাক্স। চক্রটি তাদের পকেট ভারী করতেই মূলত বঙ্গভ্যাক্সের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

ইতিমধ্যে টিকা কেনার নামে ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বেক্সিমকো ফার্মার ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক জানায়, ভারত থেকে আমদানি করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোভিড-১৯ টিকা বিতরণের খরচ দেখানো হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খরচ হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন সালমান এফ রহমান ও তার সিন্ডিকেট।

সোমবার (১৭ মার্চ) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানান, টিকা কেনার নামে রাষ্ট্রের ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে সোমবার অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমানের সিন্ডিকেটে আরও ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব লোকমান হোসেন, বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান মোদাচ্ছের আলী ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস।

দুদকে জমা হওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকা কেনার জন্য সরবরাহকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাকে।

সেখানে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো এবং সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যকার টিকা কেনার চুক্তি প্রক্রিয়ায় সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা হয়নি। যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বেক্সিমকোকে অন্তর্ভুক্ত করায় অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি মূল্যে বাংলাদেশকে সেরামের টিকা কিনতে হয়েছে। সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচত তা দিয়ে ৬৮ লাখ বেশি টিকা কেনার চুক্তি করা যেত। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতি ডোজ টিকা থেকে অন্য সব খরচ মিটিয়ে ৭৭ টাকা করে লাভ করেছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, করোনা ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিন মালেকের নেতৃত্বে একটি চক্র অন্তত ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এই সিন্ডিকেটের শক্তির বলয়েই আটকে যায় বঙ্গভ্যাক্স। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ৭০ মিলিয়ন ডোজ পেয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৪২৫ টাকা, যা মোট খরচ ২.৯৭৫ বিলিয়ন টাকা। স্বাস্থ্যসেবা সংস্থার বিজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে যে, চীন থেকে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের ৩.১৫ মিলিয়ন ডোজ আমদানিতে ২৭.৪৭৫ বিলিয়ন টাকা খরচ হয়েছে, যা প্রতিটি ৮.৭২২.২ টাকা বা ১০০ ডলারে নেমে আসে। কিন্তু ২৭ মে, একটি সরকারি কমিটি ১৫ মিলিয়ন ডোজ সিনোফার্ম ড্যাফসিন প্রতিটি ১০ ডলারে কেনার অনুমোদন দেয়। এভাবেই ক্রয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি কোভিড পরীক্ষার জন্য ৩,০০০ টাকা খরচ ও একই পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।

দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সালমান এফ রহমান সিন্ডিকেট নিজেদের পকেট ভারি করতে আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় আটকে রেখেছিল গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স অনুমোদন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরে অন্তত ৬টি চিঠি দিয়েও কোনো সহায়তা মেলেনি। হামলা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির অফিসে, গবেষকদের দেওয়া হয়েছিল হুমকিও। প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসান নিয়েও ক্ষমতাধরদের দাপটে মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে করোনার প্রকোপ শেষ হয়ে গেলে মেলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন। প্রথমে একটি আনঅফিসিয়াল মিটিংয়ে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের সঙ্গে গ্লোব বায়োটেককে প্রযুক্তি শেয়ার করার দাবি করা হয়।

বেক্সিমকো ও গ্লোব বায়োটেক মিলে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বঙ্গভ্যাক্স বাজারজাত করার কথা বলেন সালমান এফ রহমান। প্রথমে তাতে সায় দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি নিয়ে সমাধানের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছিল গ্লোব বায়োটেকের। এর মধ্যেই ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বেক্সিমকোর একটি চুক্তি হয়ে যায়। পরে বেক্সিমকো গ্রুপের মাধ্যমে সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আমদানি করার কারণে বঙ্গভ্যাক্সের আর অনুমতি দেওয়া হয়নি।

বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দপ্তর থেকে অপ্রয়োজনীয় সব শর্ত জুড়ে দিয়ে করা হয় সময়ক্ষেপণ। গ্লোব বায়োটেক থেকে সেসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হলেও পরে নতুন নতুন শর্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিঠি দিয়েছে সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল দপ্তর। আর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাব কেটে যাওয়ার পর।

করোনা টিকা কেনার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, কীভাবে এসব টাকা আত্মসাৎ হয়েছে এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। আমরা অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত জানাব।

গত বছরের ১৩ আগস্ট রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে নৌপথে পালানোর সময় সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!