অসত্য তথ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) চাকরি এবং সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রভাব খাটিয়ে দেশের ২০টি ব্যাংক থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল (সিএসআর) থেকে অর্থ গ্রহণের মামলায় পুতুলের পাশাপাশি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সাবেক চেয়ারম্যান এবং নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারকেও আসামি করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ কমিশনের উপ-পরিচালক তাহাসিন মুনাবীল হক বাদী হয়ে মামলা দুটি করেছেন বলে সংস্থাটির উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম জানিয়েছেন।
দুদকের দুই মামলার এক মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। সেই এজাহারে বলা হয়, তিনি এ পদে নিয়োগ পেতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ২০২৩ সালে সিভি পাঠান।
এতে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষকতা/শিক্ষা ম্যানুয়েল তৈরি করে আবেদন এবং পরবর্তীতে আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করেন।
মামলার এজহারে বলা হয়েছে, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভের উদ্দেশ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ২০২৩ সালে দাখিলকৃত সিভিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)- শিক্ষকতা/শিক্ষা ম্যানুয়েল তৈরি বা রিভিউ সম্পর্কিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করেও নিজেকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত মর্মে মিথ্যা দাবি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আবেদন এবং পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করায় তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৮/৪৭১ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন এর ৫(২) ধারায় একটি নিয়মিত মামলা রুজুর অনুরোধ করা হলো।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে বলা হয়, তারা পরস্পর যোগসাজশ করে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসভুক্ত ব্যাংকগুলোর সিএসআর ফান্ড থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে সূচনা ফাউন্ডেশনে টাকা দিতে চাপ দেন। এর ফলে ২০১৭ সালের মে মাসে ২০টি ব্যাংক বাধ্য হয়ে তাদের সিএসআর খাত থেকে ৩৩ কোটি ৫ লাখ টাকা সূচনা ফাউন্ডেশনকে দেয়।
এই অর্থ কীভাবে এবং কোন খাতে খরচ করা হয়েছে তা জানার জন্য অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে সূচনা ফাউন্ডেশনে দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হলেও কোনো রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি। অভিযানে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি বলে এজাহারে জানিয়েছে দুদক।
ভুয়া রেকর্ডপত্রের মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে, দাবি দুদকের।
দুদক জানায়, চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি সূচনা ফাউন্ডেশনের সভাপতিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালানো হয়। অভিযান শেষে এনফোর্সমেন্ট টিম কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করে।
ওই প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, অভিযানকালে এনফোর্সমেন্ট টিম ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ এর নিবন্ধিত কার্যালয় যার ঠিকানা: বাড়ি নং-৫৪, রোড নং-৫ (পুরাতন) ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ঢাকাতে অফিসটির অস্তিত্ব পায়নি। অনুসন্ধানকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, সূচনা ফাউন্ডেশন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, ঢাকা এর রেজিঃ নং-৮-০৯১২২ মূলে নিবন্ধিত।
২০১৪ সালের ৯ আগস্ট সূচনা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক সায়মা ওয়াজেদ হোসেন (পুতুল) ওরফে সায়মা ওয়াজেদকে চেয়ারম্যান করে ২ বছরের জন্য ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় যা মেয়াদান্তে সাধারণ সভার মাধ্যমে নবায়ন ও পুনর্গঠন করা হয়।
অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্যাবলি মোতাবেক জানা যায়, আসামি সায়মা ওয়াজেদ কর্তৃক অপর আসামি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সাবেক চেয়ারম্যান এবং নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসভুক্ত ব্যাংকসমূহকে তাদের সিএসআর ফান্ড থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে টাকা প্রদানের জন্য চাপ প্রদানের জন্য সময়ে সময়ে পত্র প্রদান করে।
তৎপ্রেক্ষিতে, ২০১৭ সালের মে মাসে ১৭টি ব্যাংক বাধ্য হয়ে তাদের সিএসআর খাত থেকে মোট ২১ কোটি টাকা প্রদান করে এবং এ প্রক্রিয়ায় সর্বমোট ২০টি ব্যাংক থেকে ৩৩.০৫ কোটি টাকা সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে প্রদানের জন্য বাধ্য করা হয়। চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্য করে আদায়কৃত ওই অর্থ পরবর্তীতে কীভাবে কোন খাতে খরচ হয়েছে সেটি জানার জন্য সূচনা ফাউন্ডেশনের ঠিকানায় অনুসন্ধানকালে পত্র প্রদান করা হলেও কোনো রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি।
যেহেতু প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি তাই ওই অর্থ উত্তোলনপূর্বক/বিভিন্ন ভুয়া রেকর্ডপত্র সৃজনপূর্বক আত্মসাৎ করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে, যা মামলা তদন্তকালে খতিয়ে দেখা হবে।
এরূপ প্রক্রিয়ায় জনহিতকর এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য জমাকৃত অর্থ (সিএসআর ফান্ড) এর এহেন অপব্যয় এবং আত্মসাৎ দণ্ডবিধি এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন এর ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।