দীর্ঘ দুই যুগেও শহরবাসীর পানি নিয়ে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি)। বিশেষ করে পানি সরবরাহ না করেই মাসিক বিল আদায় করা নিয়ে বিসিসির ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত বেশির ভাগ নাগরিক। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, সিটি করপোরেশন পানির সংযোগ না দিয়েই মাস শেষে বিল উত্তোলনকে বিধিসম্মত বলে দাবি করেছে।
তবে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ এমন দাবিকে অযৌক্তিক এবং সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভাঁওতাবাজি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পানি বা সংযোগবঞ্চিত বর্ধিত ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি এই ধরনের নাগরিকসেবা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়েছেন।
বিসিসি ও বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৬৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে পানির সংযোগ আছে ৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। পুরো এলাকায় পানির সংযোগ না থাকলেও বাসিন্দাদের কাছ থেকে শতভাগ পানির বিল আদায় করছে সিটি করপোরেশন।
মোট ৩৪ হাজার পানির লাইন বাবদ বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকা আদায় করছে বিসিসি। লাইনে পানি আসে না, এমনকি সংযোগ নেই, তারপরেও নগরবাসীকে বিল দিতে হচ্ছে, এই বিলকে বলা হচ্ছে ‘রেট’।
নগরবাসীর অভিযোগ, ভবনের প্ল্যানপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত অনুযায়ী পানির সংযোগ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে সিটি করপোরেশন। সুতরাং ভবন নির্মাণ করতে গেলে আগেই নিতে হবে পানির সংযোগ।
ফলে বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভবন মালিকদের অযথা অর্থ দিয়ে কাগজে-কলমে পানির সংযোগ নিতে হয়, হচ্ছে। সব শর্ত মেনে ভবন নির্মাণশৈলী নেওয়া হলেও শেষে দেখা যাচ্ছে, বরিশাল সিটি করপোরেশন পানি সরবরাহ করছে না।
১, ২, ৩নং ওয়ার্ডের একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, বছর পাঁচেক পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে বিসিসিতে প্ল্যান অনুমোদন চাইলে আগেই পানির সংযোগ নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু যেখানে ভবন করা হচ্ছে তার ধারে-কাছেও পানির সংযোগ নেই, এই কথা জানানোর হলেও সংযোগ বাবদ নির্ধারিত ৮ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
এরপরে পানির সংযোগ চেয়ে সিটি করপোরেশনের একাধিকবার আবেদন করা হলেও সংশ্লিষ্টরা কর্ণপাত করেনি। বাধ্য হয়ে টিউবওয়েল বসাতে চাইলে সেখানেও সিটি করপোরেশনকে নির্ধারিত হারে অর্থ দিতে হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের বিরক্তির কারণ।
নগরীর ৫নং ওয়ার্ডের একাধিক বাসিন্দা জানান, ভবনের নকশা নেওয়ার পর থেকেই মাসে ২০০ টাকা করে বিল গুনতে হয়। কিন্তু কখনো সিটি করপোরেশনের এক ফোঁটা পানিও পাননি।
বিষয়টি সিটি কপোরেশনকে একাধিকবার অবহিত করার পরেও সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে মাস শেষে একটি বিলের কপি ঠিকই বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা এক ধরনের অস্বস্তি এবং ভর্তুকি দেওয়ার শামিল।
এরপরেও সিটি করপোরেশন সংযোগ না দিয়ে পানির বিল নেওয়াকে আইনসংগত হিসেবে দাবি করেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ভবনের প্ল্যান করাতে হলে পানির সংযোগ নিতেই হবে।
সে ক্ষেত্রে পানি সরবরাহ বন্ধ থাকলেও ভবন মালিকদের বিল বকেয়া রাখার সুযোগ থাকছে না। মূলত সিটি করপোরেশনের পানি নিয়ে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষুব্ধ-বিরক্ত শহরবাসী।
বিসিসি বলছে, ভবনের নির্মাণশৈলী পাস হওয়ার আগেই পানির বিল ধার্য করা হয়। সে ক্ষেত্রে যদি কেউ সংযোগ বা পানি না পেয়ে থাকেন তাদেরকেও মাসিক বিল দিতে হয়।
পাশাপাশি টিউবওয়েল স্থাপনের ক্ষেত্রেও বিসিসি নির্ধারিত টাকা চার্জ হিসাবে গ্রহণ করে, যা করপোরেশনের আইন অনুসারে হচ্ছে। এত কিছুর পরেও বছরে মাত্র ৩৫ শতাংশ পানির বিল উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে।
তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বিসিসির একাধিক সূত্র বলছে, বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন সাত কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানির চাহিদা রয়েছে।
কিন্তু পাঁচটি ওভারহেড ও ৩৬টি পাম্প এবং পানির গাড়ির সাহায্যে রোজ সাড়ে তিন কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদা পূরণ না হওয়ায় নগরবাসী এরই মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার নলকূপ বসিয়েছে।
সূত্রটি জানায়, পানির চাহিদা মেটাতে ২০১০ সালে দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হলেও বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যাসহ বিভিন্ন অজুহাতে সেগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে। প্লান্ট দুটি সংস্কার করে আবার চালু করলে নগরবাসীর পানির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ হবে, ধারণা বিসিসির।
বিসিসির পানি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ওমর ফারুক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘বিসিসি লাইনপ্রতি সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা পানির বিল আদায় করে।
পাইপের ব্যাস ও বাড়ির তলা হিসেবে এ বিল ধার্য করা হয়। কিন্তু তারপরেও বছরে ৩৫ ভাগ বিল বকেয়া থাকে। হয়তো অনেকে পানি পাচ্ছেন না বলে বিল ঠিকমতো দিচ্ছেন না।
বর্ধিত ওয়ার্ড ২৭, ২৮, ২৯ এবং ৩০ নম্বরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিসিসি বছরের পর বছর বেলতলা ও রূপাতলীতে নির্মিত দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট সচল করার অজুহাত দেখিয়ে সময় পার করছে। কিন্তু ১০ বছরেও তা সচল করে পানি সরবরাহ করতে পারেনি।
এমনকি তাদের এলাকাসমূহে পানিতো দূরের কথা, সংযোগ না দিয়েই প্রতিমাসে বিল উত্তোলন করছে। এ নিয়ে বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ রয়েছে, যা শিগগিরই বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে বিসিসির পানি সেবাবঞ্চিত ওয়ার্ডসমূহে দ্রুততার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী।
তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিসিসি আরও অন্তত ১০টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প স্থাপন করতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এই উদ্যোগ সমাপ্ত করা গেলে শহরের ত্রিশটি ওয়ার্ডেই সংযোগ দেওয়াসহ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’