ঢাকা শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

৫৫ হাজার রোহিঙ্গা এনআইডি, নেপথ্যে হেলালুদ্দীন

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৫, ১২:৫৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

২০১৮ সালের নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে ব্যাপক তৎপর ছিলেন সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি দায়িত্ব পালন করেন নির্বাচন কমিশন সচিব হিসেবে।  ২০২২ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকা অবস্থায় অবসরে যান। গত বছরের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হন হেলালুদ্দীন।

এবার  ৫৫ হাজার ৩১০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে  তার বিরুদ্ধে। অভিযোগটি অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত সপ্তাহেই অনুসন্ধানের জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানিয়েছে, হেলালুদ্দীন আহমদের অনিয়ম খুঁজতে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা হিসেবে দুদকের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলমকে নিয়োগ করা হয়েছে। কমিশনের তরফ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনের তার সব দুর্নীতির প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। সেই হিসেবে গত সপ্তাহেই হেলালুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই চিঠি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছে দুদক।

দুদকের পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন কমিশনে দায়িত্বপালনকালে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে ৫৫ হাজারেরও বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গাকে এনআইডি দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে রাতের ভোট আয়োজনেও তার সংশ্লিষ্টতা থাকার কিছু তথ্য দুদকের হাতে এসেছে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অভিযোগটি সামনে রেখে আমাদের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এর সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিয়মগুলো নিয়েও এই অনুসন্ধানের আওতায় আনা হতে পারে। তবে এ বিষয়টি নির্ভর করছে সময়ের ওপর। কমিশনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভিযোগ অনুসন্ধান করে সেটার প্রতিবেদন জমা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তার আগেই অনুসন্ধানটি শেষ করার।  

দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রোহিঙ্গা ডাকাত নুর আলম। এ সময় তার কাছ থেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্টকার্ড পায় পুলিশ, যা ইস্যু করা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয় থেকে। ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে নুর ওই এনআইডি সংগ্রহ করে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে সে সময় অবধি ভয়াবহ এই অনিয়মের সঙ্গে হেলালুদ্দীন আহমদের নাম আসেনি। তৎকালীন দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আমলাসহ একাধিক কর্মকর্তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পান এবং রোহিঙ্গাদের জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এনআইডি প্রদানে তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পান তিনি। কিন্তু সে সময় এক অদৃশ্য শক্তি দুদকের সেই অনুসন্ধানটির আলোর মুখ দেখতে দেয়নি।

দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্র শুধু ঈদগাঁও, ইসলামাবাদেই নয় বরং কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, লামা, আলীকদমে আশ্রয় নেয়া আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে ভোটার বানিয়েছে। আর এই প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। পরে আলাদা একটি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায় নির্বাচন কমিশন। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন কক্সবাজারের ঈদগাঁও এলাকার বাসিন্দা আওয়ামী আমলা হিসেবে পরিচিত হেলালুদ্দীন আহমদ।

দুদক জানায়, অবসরের পর  তিনি নির্বাচন করার মনোবাসনা থেকে ওই এলাকায় আশ্রিত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার বানাতে শুরু করেন। যার ফলে একদিকে যেমন এলাকায় তার ভোটার তৈরি হয়। অন্যদিকে, প্রতিটি এনআইডি কার্ড দেয়ার জন্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

দুদক সংশ্লিষ্টরা জানান, হেলালুদ্দীনের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটটি শুধু তার নির্বাচনী এলাকাতেই থেমে থাকেনি। বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের টাকার বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করেছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালীদের কারনে অনুসন্ধান গভীরভাবে শেষ করা সম্ভব হয়নি।

দুদক আরও জানায়, ২০১৯ সালে তদন্তের স্বার্থে দুদকের একটি অনুসন্ধানী টিম চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে অভিযান চালায়। এ সময় ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কাজে ব্যবহৃত ৮টি ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার তথ্য পায় দুদক। তবে ৭টি ল্যাপটপের ব্যাপারে জিডি ও মামলা রেকর্ড করাসহ আইডি ব্লক করার কথা জানানো হলেও ইসির দাবি করা মিরসরাই থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি ল্যাপটপের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় নি। তখনো ৪৩৯১ আইডি নম্বরের ল্যাপটপটির আইডিও ব্লক করা হয়নি। ওই একটি ল্যাপটপ দিয়েই ২০১৬ সাল থেকে টানা ৩ বছর ধরে ৫৫ হাজার ৩১০ জন রোহিঙ্গাকে ভোটার বানানো হয়েছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজারই কক্সবাজারের ঈদগাঁও এলাকার বাসিন্দা।

অনুসন্ধানী দল ইসি’র সার্ভারে ঢুকে দেখতে পায়, ভোটার হওয়ার জন্য যে নিবন্ধন ফরম ব্যবহার করা হয় তার সিরিয়াল নম্বর ৪১৮৬৬৩০১ হতে ৪১৮৬৬৪০০ পর্যন্ত ১০০টি ফরমের একটি বই একটি অফিসের নামে ইস্যু করার নিয়ম থাকলেও এর ৬৩টি ফরম ব্যবহার করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এ ছাড়া ২৩৯১ নম্বরের ল্যাপটপ থেকে যে ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে ভোটার বানানো হয়েছে তাদের কারোর ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ কাগজপত্র  নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে আপলোড করা হয়নি। অনুসন্ধান চলাকালেই সে সময়ের নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুউদ্দীন ফোন করে দুদকের অনুসন্ধানী টিমকে অভিযান অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসতে চাপ দেন। এতেই দুদকের সন্দেহের তালিকায় আসে হেলালের নাম।

দুদক জানায়, রোহিঙ্গা ইস্যু থাকায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার ৩২ উপজেলাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের তৈরি করা নিবন্ধন ফরমের ৪১টি কলাম যথাযথভাবে পূরণ করাসহ  জাতীয়তা সনদ, জন্মনিবন্ধন, ভূমি সনদ, উদ্যোক্তা সনদের,পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন অফিসের প্রত্যয়নপত্র, বিদ্যালয়ের সনদ প্রয়োজন হয়। এসব তথ্যের কোনোটির ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ কমিটির সত্যায়িতপত্রসহ সব ডকুমেন্টের সফটকপি নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে আপলোড করতে হয়। কিন্তু এই ৫৫ হাজার ৩১০ জনের ক্ষেত্রেও পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্ট নেই ইসিতে।

এরইমধ্যে সাবেক সচিব হেলালুদ্দীনের আমলনামা যাচাই-বাছাই করতে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে রেকর্ডপত্র চেয়েছে দুদক। এসব রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে- ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ৫৫ হাজার ৩১০ রোহিঙ্গা নাগরিকের নাম, পিতার নাম, স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা। উক্ত রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণ সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বা অন্য কোনো সংস্থা থেকে কোনো তদন্ত হয়ে থাকলে তার প্রতিবেদনের সত্যায়িত কপি। হেলালুদ্দীন আহমদের নির্বাচন কমিশনে দায়িত্বপালনের বিস্তারিত তথ্য এবং তার  স্ত্রী, সন্তানদের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য তথ্য।

অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়ে শুনেছি। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আমার কাছে নেই।

উল্লেখ্য,হেলালুদ্দীন আহমদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ইসি সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে নিয়মিত গণমাধ্যমের সামনে হাজির হতেন তিনি। ওই নির্বাচনের আগে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে অংশ নেয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিএনপি। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের ৪ তলার পেছনের কনফারেন্স রুমে ২০১৮ সালের ২০শে নভেম্বর রাতে ওই গোপন বৈঠক হয় বলে গণমাধ্যমে খবর হয়েছিল।

তখন বিএনপি‘র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী অভিযোগ করেছিলেন, হেলালুদ্দীনসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাজ্জাদুল হাসান, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন সচিব মহিবুল হক, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমদ, সাবেক পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ার,  সাবেক ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার আলী আজম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ কাজী নিশাত রসুল ওই বৈঠকে অংশ নেন। পরে হেলালুদ্দীন আহমদ চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজেও একই ধরনের গোপন বৈঠক করেন বলে অভিযোগ ওঠে। তবে ওই বছরের ২৪শে নভেম্বর সন্ধ্যায় ইসিতে  এক সংবাদ সম্মেলন করে তিনি দাবি করেছিলেন, তাকে বিতর্কিত ও হেয় করার জন্য এ ধরনের প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে।