স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিএনপির প্রতিষ্ঠা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা। বিশেষত দলটির প্রতিষ্ঠাতা বীর উত্তম জিয়াউর রহমান; যিনি অত্যন্ত সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। বিরুদ্ধবাদীরা তার নানারকম সমালোচনা করলেও ব্যক্তিগত দুর্নীতি বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো অভিযোগ আজতক করতে পারেনি।
ফলে দেশবাসীর মনে এ প্রতীতি জন্মনো অসংগত নয় যে, আর যা-ই হোক তারই প্রতিষ্ঠিত দলটির নেতাকর্মীরা কোনো দুর্নীতি বা অপরাধে জড়াতে পারে না। একই কথা প্রযোজ্য আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রামী এই নির্লোভ রাজনীতিবিদ কখনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে মনে স্থান দেননি।
যাপন করে গেছেন সাধারণ জীবন। তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার পর দলটির নেতৃত্বের স্টিয়ারিং চলে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। তিনি দলটিকে পৌঁছে দেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। শেখ মুজিব থেকে পরিণত হন ‘বঙ্গবন্ধু’তে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাকে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হলেও সব সময় চেষ্টা করেছেন সৎ থাকার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন তার কর্মী-স্বজনদের বিরুদ্ধে বেশুমার দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের অভিযোগ ওঠে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নিরন্ন ও অসহায় মানুষের জন্য আসা রিলিফ সামগ্রী লুটে নেয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকেরা। শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরকে সামাল দিতে পারেননি। এই ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই তার ওপর বর্তায়।
এদের সীমাহীন দুর্নীতি লুটপাটে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘দুনিয়ায় সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পাইছি চোরের খনি। পাকিস্তানিরা আমার দেশের সব সম্পদ নিয়া গেছে, রাইখা গেছে কতগুলো চোর। এই চোরগুলোরে নিয়া গেলে বাঁচতাম।’ ওই চোরগুলোকে নিয়ে গেলে শুধু বঙ্গবন্ধু নন, গোটা বাংলাদেশ বেঁচে যেত।
কিন্তু সর্বনাশের কথা হলো, কালের পরিক্রমায় সেসব চোরের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। গত বছর গতায়ু হওয়া লীগ-সরকারের আমলে সেসব চোরের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছিল ইতালির হ্যামিলন শহরের ইঁদুরের মতো। দুর্ভাগ্য আমাদের, এখানে এমন একজন বংশীবাদক আসেননি, যিনি এই ধেড়ে এবং বাইত্তা ইঁদুরগুলোকে বাঁশি বাজিয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেবেন।
বাঁশি বাজিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি নিজে যেমন দুর্নীতি করেননি, তেমনি কোনো দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার দল ও সরকারের অভ্যন্তরে হ্যামিলনের কিছু ধেড়ে ইঁদুর বাসা বেঁধেছে। তাই ১৯৮১ সালের ২০ কি ২১ মে বিএনপির বর্ধিত সভায় বলেছিলেন, ‘আমাদের দলে কিছু মিসক্রিয়েন্ট ঢুকে পড়েছে।
তাদেরকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। অচিরেই তাদেরকে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে।’ কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, সে কাজটি তিনি করে যেতে পারেননি। এর মাত্র কয়েকদিন পরে ৩০ মে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শহিদ হন তিনি। জিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের মনে জ্বলে ওঠা আশার প্রদীপটিও নিভে যায় দপ করে।
একটি দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন জিয়া দেশবাসীকে দেখিয়েছিলেন, তা আর পূরণ হয়নি। আর তার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের বেসামাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে স্থাপন করেন দুর্নীতির বিশ্বরেকর্ড।
শুধু আর্থিক দুর্নীতিই নয়, রাষ্ট্রক্ষমতার চেয়ারে বসে অনৈতিকতা ও লাম্পট্যেরও চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। সে সময় সম্ভবত ১৯৮৫ সালে লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় এরশাদকে নিয়ে প্রতিবেদন বেরিয়েছিল ‘দ্য রিচেস্ট প্রেসিডেন্ট অব দ্য পুওরেস্ট কান্ট্রি’।
তারপর বাংলাদেশের নদ-নদী দিয়ে বহু পানি গড়িয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। অনেক দল ক্ষমতায় এসেছে আবার চলেও গেছে। কিন্তু দুর্নীতি রয়ে গেছে একই জায়গায়। বরং বিগত বছরগুলোতে তা উচ্চতায় হিমালয় পর্বতমালার এভারেস্ট শৃঙ্গকে স্পর্শ করেছিল।
ব্যাপক দুর্নীতি ও অপশাসনের কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের শোচনীয় পতনের পর মানুষের ধারণা হয়েছিল, এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো সংযত হবে।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগশূন্য মাঠে ওয়াকওভার পাওয়া দল বিএনপি নেতাকর্মীরা এমন কোনো কাজ করবে না, যা দলটি সম্বন্ধে জনমনে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়। কিন্তু জনগণের সে ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দলটির এক শ্রেণির নেতাকর্মী গত ছয় মাসে এমনসব অপকর্ম করেছে যা, সুশাসন প্রত্যাশী জনগণকে হতাশ করেছে।
তারা ইতোমধ্যেই বলতে শুরু করেছে, তাহলে কি গত বছরের ৫ আগস্ট শুধু চেহারার পরিবর্তন হয়েছে, চরিত্র একই রয়ে গেছে? কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে ‘বিএনপি নেতাকর্মী’ শব্দের পরিবর্তে ‘আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী’ বসিয়ে দিলে বোঝার উপায় থাকবে না এটা কোন আমলে সংঘটিত!
গত ১১ মার্চ ‘রূপালী বাংলাদেশ’-এ ‘বেসামাল বিএনপির তৃণমূল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে সে কথাই বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। যে ঘটনাগুলোর উল্লেখ প্রতিবেদনে করা হয়েছে তা ছয় মাস আগে যেমন ঘটেছে, এখনো তেমনটা ঘটছে। তবে শুরুতে যে মহামারি আকার ধারণ করেছিল, এখন তার প্রকোপ কিছুটা কমেছে। তবে একেবারে শেষ হয়নি।
প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেশের কোথাও না কোথাও বিএনপির ওইসব মর্দে মুমিনদের কাণ্ডকীর্তির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগবিহীন শূন্য মাঠ পেয়ে হালে পানি পেয়েছে বিএনপি-জামায়াত। বিএনপির তৃণমূল থেকে শীর্ষপর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষমতায় না এসেও স্বাদ পেতে শুরু করেছে ক্ষমতার।
রাতারাতি ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিএনপি নেতাকর্মীদের এ ধরনের কার্যকলাপে জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, আমরা খবর পাচ্ছি তৃণমূলে বেসামাল হয়ে উঠেছে বিএনপি। তারা ওপরের নির্দেশ মানতে নারাজ। তিনি মন্তব্য করেছেন, ক্ষমতায় না এসেও বিএনপি নেতাকর্মীরা হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাধর।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপির এক শ্রেণির নেতাকর্মীর অতিশয় ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার ঘটনা অসত্য নয়। তারা থানার ওসিকে ধমক দিয়ে বা পুলিশকে মারধর করে ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে আসামি। আবার ধৃত আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য সদলবলে হামলা করছে থানায়। সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ দেখলাম।
কোনো এক ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ আসায় সে এসআইকে এই বলে হুমকি দিচ্ছে- ‘আমি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি। আমি থানায় যাব না। দরকার হলে ওসিকে বলেন আমার কাছে আসতে।’ ইউনিয়ন লেভেলের একজন ছাত্রকর্মী যখন থানার ওসিকে তার কাছে আসতে বলে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না সে কতটা পাওয়ারফুল ভাবছে নিজেকে।
পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে দখল টেন্ডারবাজি ও গ্রেপ্তারবাণিজ্য। মামলার ভয় দেখিয়ে পুলিশকে দিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থকদের থানায় ধরে নিয়ে করা হচ্ছে চাঁদা আদায়। রাজধানীর নিকটবর্তী জেলার একটি থানায় গত ছয় মাসে তিনজন ওসিকে বদলি করতে হয়েছে।
বিএনপির একজন মাঝারি মাপের নেতা তার পছন্দের ওসিকে পোস্টিং দিয়ে রমরমা বাণিজ্য ফেঁদে বসলে বাগড়া দেয় অন্য একটি গ্রুপ। তারা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষকর্তার ভাইকে দিয়ে তদবির করিয়ে সেই ওসিকে প্রত্যাহার করায় দুই মাসের মাথায়। তারপর যিনি আসেন আসামি ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যর্থতার অভিযোগে পনেরো দিনের মধ্যে তাকে চলে যেতে হয়। বর্তমানে যিনি আছেন, তিনি আছে ভয়ে ভয়ে। চলছেন সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ফলে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
গত ছয় মাসে বিএনপি নেতাকর্মীদের অপকর্মের যেসব খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তা মোটেও সুখকর নয়। দীর্ঘ সতেরো বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের পরিণতির দৃষ্টান্ত চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তাদের এতটুকুু বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব কর্মীদের একাংশের এই উন্মত্ততার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছেন না তা নয়।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার কোনো ধরনের সন্ত্রাস অপকর্মে না জড়াতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন। এমনকি সন্ত্রাস-অপকর্মের কী পরিণতি হয় তাও নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেপরোয়া নেতাকর্মীরা তার কথা আমলে নিচ্ছে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না।
এব্যাপারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘বিএনপির ভাবমূর্তি যারা ক্ষুণ্ন্ন করছে তাদের আমরা কিন্তু ছাড় দিচ্ছি না। কেউ খারাপ কাজ করলে তার দায়ভার তো দল নেবে না। যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তারা ১৬ বছর আওয়ামী লীগের রোষানলের শিকার হয়েছেন।
তারপরও আমরা সেসব নেতাকর্মীকে অব্যাহতি ও বহিষ্কার করছি। আমরা তো আর নেতাকর্মীদের আইনের হাতে তুলে দিতে পারি না।’ (১১ মার্চ ২০২৫)। এত হুমকি-ধমকি, এত বহিষ্কার-বরখাস্ত, সদস্যপদ স্থগিতের শাস্তি দেওয়ার পরও বিএনপির উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা কেন বাগে আসছে না গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্যেই তার কারণ নিহিত রয়েছে।
তিনি নিজেই বলেছেন, নেতাকর্মীদের অপরাধের জন্য তারা দলীয় শাস্তি দিচ্ছেন, তবে আইনের কাছে তুলে দিতে পারেন না। এর ফলে ওইসব নেতাকর্মী দলে না থাকলেও কিছুদিন চুপচাপ থেকে কায়দা-কৌশল করে আবার ভিড়ে যাচ্ছে দলে। আওয়ামী লীগের পতনের পর মানুষ চেয়ে আছে বিএনপির দিকে। তাদের প্রত্যাশা এ দলটি এমন কিছু করবে না, যা তাদেরকে হতাশ করবে। কিন্তু দলটির নেতাকর্মীদের একাংশের কার্যকলাপে তাদের সে প্রত্যাশা হতাশার চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বসেছে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
আপনার মতামত লিখুন :